ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হুমা পাখির স্মৃতিতে ভারতেশ্বরী হোমস

নাসরিন সুলতানা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৫, ২৯ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ০৫:৫৫, ৩০ অক্টোবর ২০২০
হুমা পাখির স্মৃতিতে ভারতেশ্বরী হোমস

ছবি: বিজু, নাগর আলী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমসকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২০’ প্রদান করেন। এ উপলক্ষে ভারতেশ্বরী হোমসের প্রাক্তন ছাত্রী নাসরিন সুলতানা স্মৃতিচারণ করেছেন। 

প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে গণভবন থেকে অনলাইনে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

এটা আমার প্রিয় বন্ধু ও সহপাঠি শাহানা পারভীনের হাতের লেখা। ভাবছেন ৪০/৪২ বছর পর আমার এক স্কুল সহপাঠীর হাতের লেখা, ওর ছবি, বিশেষ করে যে ছবিতে আমি নেই, সে ছবি কেন আমার স্মৃতির অ্যালবামের অংশ, আর এর সঙ্গে আজকের করোনাভাইরাসেরই বা কী সম্পর্ক, তাই না! আসলে এর পেছনে রয়েছে অত্যন্ত সুন্দর একটি ছোট্ট গল্প। সেটাই আজ শেয়ার করবো আপনাদের সবার সঙ্গে। 

শুরুতেই একটি কথা বলি। আমার ডাকনাম হুমা। বি. হোমসের মেয়েরা আমাকে আদর করে ডাকতো হুমা পাখি। এই কথাগুলো লিখলাম কারণ, ভারতেশ্বরী হোমসে পড়া ওই সময়ে আমার জুনিয়র বা সিনিয়র যেসব ছাত্রী বা ভারতেশ্বরী হোমসের সঙ্গে যুক্ত  যারা আমার এই লেখা পড়বেন, তারা খুব সহজেই আমাকে চিনতে পারবেন।  কারণ তারা আমার পোশাকি নাম জানেন। 

আমার আজকের ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার অর্থাৎ আমার বর্তমান মুখমণ্ডল দেখে আমাকে চিনতে পারার কোনোই সম্ভাবনা নেই। তাই আমার ওই পরিচয়টি উল্লেখ করলাম। ফলে আমাকে চিনতে পারার কারণে আমার এই লেখাটা পড়ে আমাকে ওনাদের আরও বেশি কাছে নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই। 

এই ছবিটা সেই প্রায় ৪১/৪২ বছর ধরে আমার অ্যালবামবন্দি ছিল। কখনও কি ভেবেছিলাম যে, একদিন এই পৃথিবীতে করোনা নামক ভয়ানক এক সংক্রমণ ব্যাধি আসবে, আর আমি তার সঙ্গে আমার ভারতেশ্বরী হোমসের এই ছবিটির সুক্ষ্ম একটি যোগসূত্র খুঁজে পাবো, আর এ দুটোর সঙ্গে একটি যোগসূত্র খুঁজে পাবো আর এমন ধারা একটি পোস্ট দেবো আমার ফেবু দেয়ালে! সত্যিই বিচিত্র এ জীবন! বিচিত্র এর প্রতিটি পদক্ষেপ!

যদিও আমি আজ থেকে ৩৯ বছর আগে ভারতেশ্বরী হোমস থেকে এসএসসি শেষ করে সব বন্ধুদের ছেড়ে চলে এসেছি, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমি এখনও ওদের অনেকের হাতের লেখা দেখলেই চিনতে পারি! এর কারণ ওখানে আমরা বছরের ১০ মাসই ডরমে থাকতাম একসঙ্গে পাশাপাশি সবাই মিলে। সারাক্ষণ। অনুক্ষণ। আমরা সব বন্ধুরা এতটাই কাছাকাছি থাকতাম যে, সবাই সবাইকে খুব কাছে থেকে দেখার বোঝার সুযোগ পেয়েছি। আমরা বি. হোমসের বন্ধুরা সবাই এরকমই, একেবারে হরিহর আত্মা!

আমার সময়ে বি. হোমসে দুজন প্রফেসনাল ফটোগ্রাফার ছিলেন, নাগর আলী ভাই আর বিজুদা। ওনারা দুজনই বি. হোমসের নানা উৎসবে পার্বণে আমাদের একক বা গ্রুপ ছবি তুলতেন। একক ছবি দু’তিন কপি করলেও গ্রুপ ছবিতে সাধারণত যতজন থাকতো ততটি বা গুরুত্বপূর্ণ ছবি হলে কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি সংখ্যক কপি প্রিন্ট করতেন ওনারা।

আমাদের সময় (আমাদের সময় বলছি কারণ এখনও ওই রেওয়াজ প্রচলিত আছে কি না তা আমার জানা নেই) বি. হোমসে একটি সুন্দর রেওয়াজ প্রচলিত ছিল যে, আমরা একজন আরেকজনকে নিজের ছবি বা যেকোনো গ্রুপ ছবি বিজুদা বা নাগর আলী ভাই এর কাছ থেকে কিনে নিয়ে একজন আরেকজনকে উপহার দিতাম বা দিতে পারতাম।

আবার কখনও কখনও আমরা নিজেদের পয়সায় ভালোলাগা অন্য কারও ছবিও কিনে নিতাম। কিনে নিয়ে প্রায়ঃশই তাতে দু’একটি শব্দ/বাক্য/বিখ্যাত কোনো উক্তি ইত্যাদি কিছু একটা স্মৃতি হিসেবে ‘কালির কলমে’ লিখে দিতাম ওই ছবির পিঠে। আমার আজকের এ ছবিটি আমার বন্ধু শাহানা আমাকে উপহার দিয়েছিল। হয়তো ওর এখন আর সেটা মনেও নেই। 

আরেকটি কথা, ‘কালির কলমে’ কথাটি লিখলাম, কারণ তখন আমরা সব্বাই ফাউন্টেন পেন বা পেন্সিল ব্যবহার করতাম। তখনো কিন্তু আজকের মত বলপেন আবিষ্কার হয়নি বা হলেও আমাদের হাতে তা এসে পৌঁছায়নি। 

যাইহোক, শাহানা পারভীন ছিল আমার সহপাঠী। এখন সপরিবারে প্রবাসী। আমি ভারতেশ্বরী হোমসে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৭৮ সালে। আর ও অনেক আগে থেকেই ওখানে পড়তো। সবার মতো ও আমাদের সবার খুব ভালো বন্ধু ছিল, এখনো আছে, আলহামদুলিলা­হ্। 

আজ আমার স্মৃতির এলবাম হাতরে যখন এ ছবিটা পেলাম, তখন এ ছবির সঙ্গে আজকের করোনাভাইরাসের বাস্তবতার যে মিল আমি খুঁজে পেলাম, সেটা তুলে ধরতেই আজকের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। 

আমাদের বন্ধু শাহানা পারভীন ওরফে ক্ষুধিত পাষাণের মেহের আলীর বিরল সব গুণের কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। যদিও ওর সব গুণের কথা লিখে শেষ করার জন্য ফেবু এর এ দেয়াল নিতান্তই ছোট্ট। তারপরও আমি কিছুতেই লোভ সামলাতে পারছি না ওকে নিয়ে কিছু লিখার। 

সদা হাস্যোজ্জল প্রাণোচ্ছল এক বন্ধু আমাদের। কখনো কখনো প্রাণ খুলে গগন ফাটিয়ে হাসতো, আবার কখনো কখনো মুখ টিপে অসাধারণ এক রোমান্টিক হাসিতে ভরে থাকতো ওর মিষ্টি মুখখানা। ও হ্যাঁ, তাই বলে যে আমাদের মধ্যে কখনো মনোমালিন্য বা ঝগড়া-ঝাঁটি হতো না, তা কিন্তু একেবারেই নয়! তবে ওই পর্বটি ছিল অতি তুচ্ছ, নগন্য, স্বল্পকালীন।

ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েদের এই এক গুণ, ওরা সবাই সবাইকে নিয়ে এক ছাদের নিচে সবসময় হেসে-খেলে আর ভালবেসে একে অপরের সকল প্রয়োজনে পাশে থেকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গেই সময় কাটায়। স্কুল জীবনে স্কুলের বন্ধুদের সাথে রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা টানা ১০ মাস ধরে (বাকি দুই মাস টানা ছুটি থাকতো) একসঙ্গে একই নিবাসে থাকা-খাওয়া-পড়াশুনাসহ সকল কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে সময় কাটানো, এ যে ছিল আমাদের কাছে রীতিমতো বেহেস্তবাসের সমতূল্য! 

আবার শাহানাতে ফিরে যাই। ও উচ্চতা বা হাইটে ছিল অনেক লম্বা। ফলে হোমসের ড্রিল দলের নিয়মিত কসরতে শুরুতেই ও প্রথম গ্রুপের প্রথম লাইনে, এরপর প্রথম গ্রুপের ক্যাপ্টেন, এরপর পুরো দলের লিড ক্যারেক্টার হিসেবে কসরত করেছে হোমসের থাকাকালীন বাকী পুরো সময়টা। সে সময়ে জাতীয় বিভিন্ন দিবসে শারীরিক কসরত প্রদর্শনের জন্য বহুবার আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে গিয়েছি। আমার ওই সময়ে প্রতিবারই শাহানা ছিল আমাদের ড্রিল ক্যাপ্টেন। বলাই বাহুল্য যে, প্রতিবারই আমরা প্রথম পুরস্কার পেয়েছি। আহা! কত স্মৃতিময় সুন্দর সব দিন ছিল তখন।

শ্রদ্ধেয়া ‘কালু দিদি’ ছিলেন আমাদের মেন্টর। আয়রন লেডি। আমাদের শারীরিক কসরত প্রশিক্ষক, যার হাত ধরে আমরা প্রতিবছর বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কসরত পুরস্কার পেয়েছি অবিরাম, তার দিনরাতের ঘামঝরা প্রচেষ্টাই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতো ওই অমনধারা নয়নাভিরাম শারীরিক কসরত করে প্রথম পুরস্কার জিতে আসতে। শুনেছি শ্রদ্ধেয়া ‘কালু দিদি’ আজ আর আমাদের পাশে নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। প্রার্থনা করি ভালো থাকুন তিনি ওখানে। তিনি নেই কিন্তু তার দেখানো পথ ধরেই আজও হেঁটে চলছে বি. হোমস আর এখনও বি. হোমসই চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর, আলহামদুলিলা-হ্! 

কি যে অপূর্ব লাগতো, যখন ২৬ মার্চ অথবা ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জাতীয় কসরত প্রোগ্রামে ভারতেশ্বরী হোমসের পুরো দলের পক্ষে শ্রদ্ধেয়া ‘কালু দিদি’ আর শাহানা, এ দু’জন মিলে স্যালুট করে মার্চ পাস্ট করতে করতে সদর্পে এগিয়ে যেত! ওয়াওওওওও..........হোহ্...........

মজার আরেকটি ব্যাপার হলো, শাহানা খুব লম্বা ছিল বিধায় কোনো নাটকেই ওর বিপরীতে নায়িকা খুঁজে পাওয়া যেত না। তাই ওকে প্রায় সবসময়ই পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করতে হতো। সে ছিলছিলা আর ওর অভিনয় দক্ষতার কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জগৎ বিখ্যাত ছোটগল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাটকীয় চরিত্র ‘মেহের আলী’- চরিত্রে অভিনয় করার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিল ও। 

এ ফাঁকে বলে নেই, সেনাপতি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যে লিপি আপা, উনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী সুন্দরী স্লিম লম্বা হাস্যোজ্জল এক বড় আপু। উনি আমাদের ছোটদের খুব খুব খুব স্নেহ করতেন। বি. হোমসের সকল কর্মকাণ্ডেই, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অগ্রভাগে থাকতেন তিনি। যদিও তার সাথে এখন আর কোন যোগাযোগ নেই, কিন্তু তিনি আমার মানসপটে আজও সমুজ্জ্বল। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন প্রিয় লিপি আপু।

এই স্মৃতিচারণে যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো, ভারতেশ্বরী হোমসের মির্জা হল অডিটোরিয়ামটির কথা। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সুসজ্জিত, প্রশস্ত, প্রয়োজনীয় সকল উপকরণে সমৃদ্ধ একটি অডিটোরিয়াম। আধুনিক গ্রিনরুম, বিশ্রামাগার, প্যানট্রি, মঞ্চে সামনে বা পেছনে থেকে ওঠা-নামার জন্য একাধিক প্রবেশ-নির্গমন পথ, দৃশ্যের প্রয়োজনে মঞ্চের উপর থেকে রোদ্দচ্ছটা-বৃষ্টিপাত-ফুল বর্ষণ-তুষারপাত-আলোক সজ্জা ও আলোর বিচ্ছুরণ, ইত্যাদি সব কিছুরই ব্যবস্থাসহ কি নেই এই হলে। মজবুত কাঠের তৈরি এর বনেদি পাটাতন, বিশেষ কোন দৃশ্যের প্রয়োজনে পাটাতনের নিচ থেকে উঠে আসার জন্য, বা আগুনের ফোয়ারা, বা ঝরনা বিচ্ছুরণ, ইত্যাদির জন্য সকল ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক লাইটিং ও শব্দ সিস্টেম, এক কথায় অতুলনীয়। 

সবচেয়ে রোমাঞ্চকর হলো এর ব্যাকগ্রাউন্ড চিত্রের সমাহার, যার প্রায় সবগুলোই ছিল গুণী শিল্পী শ্রদ্ধেয় বাদল’দার হাতে ক্যানভাসের উপর রঙ-তুলির আঁচরে অঁঙ্কিত সব চিত্রলেখা। দৃশ্যের প্রয়োজনে আঁকা অনবদ্য এই ব্যাকগ্রাউন্ড শিটগুলো রোল রোল করে মঞ্চের পেছনটাতে সব স্তুপ করা থাকতো। আমরা প্রয়োজনমত সব সাজিয়ে নিতাম। ফলে মির্জাহলের ওই বিখ্যাত মঞ্চে নাটক বা যেকোনো শিল্পকর্মে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া সত্যিই ছিল এক দুর্দান্ত দূর্লভ ভাগ্যের ব্যাপার। 

যাইহোক, আমাদের স্কুলে সারাবছর প্রায় সব পর্বণেই নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এর মাঝে মাঝে আবার কিছু বাৎসরিক অনুষ্ঠানও হতো। যেমন বাৎসরিক প্রতিযোগিতা, নাটক, ইত্যাদি। তারই একটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জগৎ বিখ্যাত এ ছোটগল্পের মঞ্চায়ন।

এ নাটকের রঙিন স্মৃতি আজও আমার স্মৃতির মানসপটে জলজল করছে। খুব সুন্দর একটি নাটক। এত আড়ম্বর করে মঞ্চায়ন করা হয়েছিল এটা, যা আপনারা ভাবতেও পারবেন না। নাটকটি যেহেতু রাজাধিরাজ বা জমিদারদের নিয়ে তাই এর সাজ পোশাকও ছিল তেমনই রাজকীয় টাইপের। 

বি. হোমসের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপ্রিয় শ্রদ্ধেয় জ্যাঠামণি (স্বর্গীয় রনদা প্রসাদ সাহা) এর একমাত্র ছেলে রবি প্রসাদ সাহার স্ত্রী আমাদের নয়নের মণি প্রাণাধিক প্রিয় বৌদি তার বিয়ের যত মহামূল্যবান বেনারসি শাড়ি ছিল, তা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন এ নাটকের নায়ক-নায়িকা আর অন্যান্য কলা-কুশলীদের। 

এ ছাড়াও আমাদের মেকআপ করে দিতেন শ্রদ্ধেয় বাদল’দা। কি ছেলে চরিত্র কি মেয়ে চরিত্র বা কি রোমান্টিক চরিত্র বা রাজাধিরাজ বা আধুনিক নায়ক নায়িকা বা কমেডি বা ফ্যান্টাসি! কোনোটাতেই তার অভিজ্ঞতা আর পারদর্শিতার কোনো অভাব ছিল না কখনও! 

এমনকি প্রতিটি পূজোতেও প্রতিমা প্রতিষ্ঠা, প্রতিমার সাজ-পোশাক, প্যান্ডেলের সাজ-সজ্জা সবই তিনি তার নিখুঁত হাতে ফুটিয়ে তুলতেন নিরলস চিত্তে, নির্ভুলভাবে। কখনো এর ব্যত্যয় ঘটেনি এতটুকুও। কি যে অপূর্ব আঁকিয়ে হাত ছিল ওনার। মেহের আলী চরিত্রের এই মেকআপটাই কিন্তু তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত!

এ নাটকে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছিল আমাদের তিন বছরের জুনিয়র বন্ধু সংগীতা মালা। এখানে না বললেই নয় যে, সংগীতা মালা আর আজকের বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত স্বনামধন্য নায়িকা অরুণা বিশ্বাস, এ দু’জন ছিল ভারতেশ্বরী হোমসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নাচিয়ে। নাচের ক্ষেত্রে ওদের তুলনা শুধু ওরাই। তুলনাহীন। ৎ

নাচের ক্ষেত্রে ওরা যে মাপের শিল্পী ছিল, তা বর্ণনার ভাষা আমার জানা নেই। এ নাটকে সেই ছোট্ট আপু সংগীতা মালা আর লিপি আপার অভিনীত ‘এই রাত তোমার আমার, ঐ চাঁদ তোমার আমার, শুধু দু’জনে’- শ্রদ্ধেয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর সেই কালজয়ী গানের দৃশ্য আজও আমার কাছে জগৎ শ্রেষ্ঠ একটি দৃশ্য, যা আজও আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, কান পাতলেই শুনতে পাই। 

নাটকের রিহার্সেল করতে প্রায় প্রতিদিনই আমরা মির্জা হলে যেতাম। সেখানে উপস্থিত থাকতেন ভারতেশ্বরী হোমসের পরম শ্রদ্ধেয়া প্রিন্সিপাল মিস মুৎসুদ্দী, বৌদি, কালুদিদি, বাদলদা, মিস দে, মিস রয়, আশাদি, অমলাদিসহ আরও অনেকজন। মাঝে মাঝে শ্রদ্ধেয়া মিসেস পতিও থাকতেন ওই রিহার্সেল অনুষ্ঠানে (জ্যাঠামণির ছোট মেয়ে এবং স্বনামখ্যাত প্রফেসর ডা. পতির সহধর্মিণী মিসেস জয়া পতি)। 

রিহার্সাল চলাকালীন সরিষা পরিমাণ কোনো ভুল হলেই শ্রদ্ধেয়া মিসেস পতি বলে উঠতেন, ‘ও বাদল, ও কালু কিচ্ছু হয় নাই, কিচ্ছু হয় নাই। আবার কর। ওগো ঠিকমতো রিহার্সাল করা।’ এতসব নিবিড় তত্ত্বাবধায়নের ফলেই ভারতেশ্বরী হোমসের কোল চিরে বেড়িয়ে আসতো একেকটা মাস্টার পিস নাটক, গীতিনাট্য, একাংকীকা, ইত্যাদি। নাহ্! সত্যিই বলছি, আমি কিন্তু একটুও বানিয়ে বাড়িয়ে বলছি না। এটাই ফ্যাক্ট। 

এই করোনা আতঙ্কের দিনে এমনধারা স্মৃতিচারণের কারণটা হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষুধিত পাষাণ ছোটগল্পের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘তফাৎ যাও! তফাৎ যাও!’

আজকাল পত্রিকা, টিভি, ফেবু, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, রেডিও, রাস্তায় সবখানেই ওই উক্তি/ডায়লগের মতোই আমরা করোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য সবাই সবাইকে অনবরত সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের কথা বলে চলেছি। বলছি নিরাপদ দূরত্বে থাকুন, নিরাপদ দূরত্ব মেনে চলুন! আর তার সূত্র ধরেই মনে পড়লো যেন আজ সবাই আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষুধিত পাষাণ ছোটগল্পের মতো একেকজন মেহের আলী। আর সবাই যেন সবাইকে বিরামহীনভাবে বলে চলেছি ক্ষুধিত পাষাণ ছোটগল্পের সেই বিখ্যাত ডায়লগ- ‘তফাৎ যাও! তফাৎ যাও!’

লেখক: প্রাক্তন ছাত্রী, ভারতেশ্বরী হোমস ও যুগ্ম সচিব, অর্থ বিভাগ।

ঢাকা/কিসমত/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়