ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘আমাগো সুখ নাই, সুখ হইবো মরলে’ 

নিফাত সুলতানা মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৫, ৩১ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৭:৫৬, ৩১ অক্টোবর ২০২০
‘আমাগো সুখ নাই, সুখ হইবো মরলে’ 

‘খালাম্মা চুড়ি নিবেন চুড়ি? ভালো ভালো চুড়ি আছে, কয়েকজোড়া নতুন নতুন চুড়ি আছে’। টিএসসির মোড়ে পথের ধারে বসে এভাবেই পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন শিল্পী খাতুন। 

অনেকেই তাকে শিল্পী খালা বলে ডাকে। টিএসসির মোড়ে প্রায় ১৭ বছর ধরে চুড়ি বিক্রি করে আসছেন তিনি। আশেপাশের মানুষগুলোর ন্যায় অলিগলিও তাকে চেনে, ঠিক যেন আত্মার আপন। ঢাবির ছাত্রীরা ভালোভাবেই জানেন শিল্পী খালার কাছে আসলে হাতভর্তি স্বল্পমূল্যে লাল-নীল চুড়ি পাওয়া যাবে।

তেজগাঁও থেকে প্রতিদিন ঝুড়ি ভর্তি করে চুড়ি এনে বসেন টিএসসির রাস্তার ধারে। রোদ-বৃষ্টি কিংবা ঝড় সবই ব্যর্থ তার পথ আটকাতে।  

শিল্পী বলেন, চুড়ি বিক্রি কইরা পাঁচ পোলা-মাইয়া লইয়া সংসার চালাই। যহন থেইকা পোলা-মাইয়া লইয়া খুব অভাবে পড়ি, তহন থেইকা চুড়ি বিক্রি করা শুরু করছি। চুড়ি বিক্রি কইরা তেমন উন্নতি করতে পারি নাই, তয় কি আর করা পোলা-মাইয়াগো মুখে খাওন তুইলা দেওনের ব্যবস্থা হইলেই আমার চিন্তা কমে।’ 

‘কোনরকম খাইয়া জীবন চালাইতে পারি এই চুড়ি বিক্রি কইরা। নারী দেইখা সবাই তো সবার ব্যথা বোঝে না। কোনটা করলে শান্তি পামু? সকাল ১০টা থেইকা রাত ৮টা পর্যন্ত বসে থাকি’, বলেন তিনি।

শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসির পথ ধরে দেখা মিলবে এমন বেশকিছু চুড়ির পসরা। ওদের সবারই একটা গল্প আছে, যে গল্পগুলো ছাপানো পাতার গল্প নয়! একেকটা জীবন্ত গল্প। ঝুড়িভর্তি চুড়ি সাজিয়ে বসে থাকা তাদের নিত্য দিনকার রুটিনবাঁধা জীবনের মূল অংশ। বাহারি চুড়ি সাজিয়ে বসে থাকেন তারা।  তাদের সব জানা, কোন রঙের চুড়ি সবাই পচ্ছন্দ করবে, কার হাতে কোন রঙ মানাবে। অনেক রঙের চুড়ির সমাহারে এ যেন এক শখের হাট।

এই পূজায় বেচাবিক্রি কেমন হয়েছে, জানতে চাইলে শিল্পী বলেন, ‘করোনার লাইগ্যা এবার বেচতি পারি নাই। আর যা বসছি, দুয়েকদিন তাতেও পুলিশে উঠাই দিছে আমাগো।’

বন্ধুকে নিয়ে চুড়ি কিনতে এসেছেন সানজিদা। ঢাবিতেই পড়ছেন বলে জানান তিনি। শিল্পী খালা তার পরিচিত মুখ। 

সানজিদা বলেন, ‘সবসময় দেখি খালা ম্লানমুখে চেয়ে থাকে সামনে হেঁটে যাওয়া পথের দিকে। যদি কেউ চুড়ি নিতে দাঁড়িয়ে যায়, দাঁড়াতেই হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেন ‘খালা চুড়ি নিবেন? দেখেন অনেক রঙের চুড়ি আছে। পড়ে দেখেন যেই রঙ নিবেন, সেটাই মানাইবো’ ডজন ৫০ কইরা আজও কয়েক রঙের চুড়ি দেখিয়ে হাতে পরিয়ে দিয়ে এক অন্যরকম মায়ায় বাঁধিয়ে দেন। এভাবেই আমরা চুড়ি নিই।’

আয়ের কথা জিজ্ঞেস করাতে শিল্পী বলেন, ‘চুড়ি বিক্রি করে এখন আয় হয় না। করোনার আগে যা জমাইছি, সেসব দিয়ে অল্প কয়েকদিন চলছে। করোনার কারণে ভার্সিটি বন্ধ, এখন আর লাভ হয় না। কোনোরকম সংসার যাও চলতো, তাও এখন টেনে-হিঁচড়ে চলে। আগে যেমন বিক্রি হতো, এখন হয় না। সারাদিনে ২০০/৩০০ টাকা বিক্রি হয়। যা দিয়ে চলতে কষ্ট হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘স্বামী পেশাতে সুই, তাকি খেলনা মাল বিক্রি করে। দিনে ২০০ টাকাও বিক্রি করতে পারেন না। তার আয়ে চলে না। পোলাপানের মুখে তো ভাত দেওয়া লাগবো, তাই দিনভর চু্ড়ি নিয়ে বসি। এই কষ্ট থেইকা মরে যাওন ভালা, আমাগো সুখ নাই সুখ হইবো মরলে।’

লেখক: শিক্ষার্থী, বোটানি ডিপার্টমেন্ট, সরকারি তিতুমীর কলেজ। 

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়