ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ইতিহাসের লড়াকু বীরদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

অনন্য প্রতীক রাউত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০০, ৩ নভেম্বর ২০২০  
ইতিহাসের লড়াকু বীরদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

আজ ৩ নভেম্বর, দিনটি বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায় এই দিনটি। যেদিন নির্মমভাবে স্বৈরতন্ত্রের কষাঘাতে সমাপ্তি ঘটেছিল চার বীর সন্তানের জীবনের, তবে সৃষ্টি হয়েছিল দৃঢ় আদর্শের দৃষান্তমূলক নজির। 

তাঁরা জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন হাসিমুখে কিন্তু বিচ্যুত হননি পিতা মুজিবের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক ও শোষণ মুক্ত সমাজ বির্নিমাণের আদর্শ থেকে৷ বাংলাদেশ সৃষ্টির সব আন্দোলনেই যারা ছিলেন জাতির জনকের সুযোগ্য সহযোগী। দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণের পর উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও পরবর্তী সব আন্দোলনে বাংলার মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়ে গেছেন জাতীয় চার নেতা- শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপ-রাষ্ট্রপতি, মুজিব নগর সরকার), শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ (প্রধানমন্ত্রী, মুজিবনগর সরকার), শহীদ ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী (অর্থ মন্ত্রী, মুজিব নগর সরকার), শহীদ এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, কৃষি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, মুজিব নগর সরকার)। 

প্রকৃতপক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, তখন এই চার নেতাই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী পরাধীন দেশের তমকা ঘোচাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখেন৷ বিশেষ করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। মুজিব নগর সরকারকে গতিশীল করা ও বহির্বিশ্বের অন্যান্য দূতাবাসগুলোর সঙ্গে কার্যকরী কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনে তাঁর ভূমিকা অবশ্যই অনেক উপরের দিকে। 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা আত্মপ্রকাশ করার পর বঙ্গবন্ধু যখন ফিরে আসেন, তখন থেকেই এই মহান চার নেতা মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ বির্নিমাণে নেতৃত্বের ঝলক দেখান। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের আঁধার রাত যখন ধ্বংস করে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নকে, তখন অনেকেই সুযোগ-সন্ধানী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও কেউ পটাতে পারেননি তাঁদের। জীবনের বিনিময়ে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন আদর্শ কাকে বলে। 

সেই রাতে কী ঘটেছিল? 

জেলখানার সেই ঘটনা জানার আগে সংক্ষেপে জানা প্রয়োজন আরও কিছু তথ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকার পুরোপুরি সেনা সরকার ছিল না। অন্যদিকে ১৫ আগস্ট থেকে অভ্যুত্থানকারী রশিদ-ফারুক ও তার কিছু সহযোগী অবস্থান নেন বঙ্গভবনে। 

মোশতাক ও তার সরকারের ওপর ছিল তাদের যথেষ্ট প্রভাব। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর একাংশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ। এই প্রেক্ষাপটে ২ নভেম্বর মধ্যরাতে (ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী তখন ৩ নভেম্বর) মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আধাসামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ। এই অভ্যুত্থানকালেই মোশতাক-রশিদ-ফারুকের প্রেরিত ঘাতক দল জেলখানায় হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে।

১৫ আগস্টের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীসহ আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাকে আটক করে কেন্দ্রীয় কারাগারের রাখা হয়েছিল। নিউ জেলের পাশাপাশি তিনটি রুমে তাঁদের রাখা হয়। ১ নম্বর ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদসহ ৮ জন বন্দি। ২ নম্বর রুমে ছিলেন এ এইচ কামারুজ্জামানসহ ১৩ জন। ৩ নম্বর রুমে ছিলেন এম মনসুর আলীসহ ২৬ জন।

সেই রাতে ১ নম্বর রুমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে রেখে বাকি ছয়জন বন্দিকে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। ২ নম্বর রুম থেকে এ এইচ কামারুজ্জামান ও ৩ নম্বর রুম থেকে এম মনসুর আলীকে ১ নম্বর রুমে নেওয়া হয়। এই রুমেই তাঁদের চারজনকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়।

কলঙ্কজনক এই অধ্যায় বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের অবস্থানকে করে পদানত। পাশাপাশি, স্বপ্নের বাংলাদেশে বিকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী অপশক্তির। সোনালী শ্যামল ভূমি পরিণত হয় অনৈতিকতা আর ক্ষমতার লোভে সৃষ্ট নোংরা রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। আর জীবনের বিনিময়ে এই মহান নেতারা পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যান আদর্শের চূড়ান্ত নমুনা। যা চিরকাল সমুন্নত থাকবে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায়।

বিনম্র শ্রদ্ধা ইতিহাসের লড়াকু বীরদের প্রতি। যাদের সংগ্রামে গড়ে উঠেছে এই স্বাধীন বাংলাদেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

জবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়