ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘নারী জাগরণই পারে ধর্ষণ ঠেকাতে’

আমজাদ হোসেন হৃদয় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৮, ৯ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৬:৪৪, ৯ নভেম্বর ২০২০
‘নারী জাগরণই পারে ধর্ষণ ঠেকাতে’

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে উৎকণ্ঠার বিষয়টি ধর্ষণ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ধর্ষণ হচ্ছে। সিলেটের এমসি কলেজ, খাগড়াছড়ি, সাভার, নোয়াখালীতে ছাড়াও সম্প্রতি আরও বেশ কিছু ধর্ষণ হয়েছে। 

সারাদেশে আন্দোলন, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আইন প্রণয়নের পরও যেন থামছে না এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা। তবে ধর্ষণ রোধে কী ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা, তাদের ভাবনাগুলো তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমজাদ হোসেন হৃদয়।

তানিয়া আক্তার তাপসী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সামাজিক ব্যাধি ধর্ষণ দূরীকরণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষা। কারণ বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা আমরা পরিবার থেকেই শিখি। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আমি একজন নারী বলেই যে আমি দুর্বল নয়, নারী ও পুরুষের সমানতালে সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে তা পারিবারিক শিক্ষার অংশ। পাশাপাশি উন্নত মানসিকতা বহন করলে শুধু পোশাকের দোহাই দিয়ে একজন বৃদ্ধা, একজন শিশু, একজন মা, একজন বোন ধর্ষিত হবে না, হতে পারে না। ধর্ষকের দ্রুত সর্বোচ্চ শাস্তি যেন নিশ্চিত করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে ধর্ষণের কথা কেউ চিন্তাও করতে না পারে।

মুমতা হেনা মীম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের প্রত্যেককেই নিজের অবস্থান থেকে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুরু করতে হবে একেবারে নিজের ঘর থেকেই। কারণ, আজও অনেক মেয়ে নিজের ঘরে, আপনজন, কাছের মানুষের দ্বারা নির্যাতিত হয়, যেটা প্রকাশ্যে আসে না কেবলমাত্র লোকলজ্জা আর সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে। 

ধর্ষণ রোধে নারীকে ‘ভোগের সামগ্রী’ হিসেবে ভাবার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ‘মানুষ’ ভাবার শিক্ষা দিতে হবে পরিবার থেকেই। সচেতনতা, সতর্কতা, সামাজিক ও আইনি প্রতিকার সমাজে ধর্ষণ হ্রাস করতে পারে। বর্তমানে ধর্ষণের শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ করা হয়েছে। যা একটি ইতিবাচক দিক। তবে এটা মনে রাখতে হবে, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।’ ধর্ষণ হওয়ার পরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার চাইতে ধর্ষণ না হওয়াই কি উত্তম নয়?

সুমাইয়া মোস্তারী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সৃষ্টিজগতে নারী-পুরুষ একে-অন্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী আজও অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। আমাদের দেশে উদ্বেগজনক হারে নারী-শিশুদের প্রতি ধর্ষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে, নারী হিসেবে নিজেকে কোথাও নিরাপদ ভাবতে পারছি না। ভিকটিমকে ডাক্তারি পরীক্ষা, সমাজের কটুক্তি, চারিত্রিক অপবাদসহ নানাভাবে হেনস্থা হতে হয়। 

বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রোধ করতে হবে। যথাযথ বিচার না হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের মতো জঘণ্য ঘটনা ঘটছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করা গেলে ধর্ষণের ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে আমি মনে করি।

উম্মে সুমাইয়া জাহান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ধর্ষণের শাস্তি নির্ধারণের আগে ধর্ষণ কেন হয় বা ধর্ষকের উৎপত্তি কই থেকে এটা খুঁজে বের করলে আরও সহজে ধর্ষণ থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার জন্য এদেশে মেয়েদের সঠিক মূল্য দেওয়া হয় না। মেয়েদের সামাজিক মর্যাদাও তাতে ক্ষুণ্ন হয়। আমাদের ছেলে সন্তানের প্রতি অধিক সচেতন থাকতে হবে পরিবার থেকেও। একটা মেয়েকে যেভাবে রক্ষণশীলভাবে গড়ে তোলা হয়, ছেলেদেরও সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। 

পরিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা, ছেলেমেয়েদের দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা করানো, স্কুলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কাজে ছেলেমেয়েদের আগ্রহ করে তুলতে হবে। এতে করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল হবে। আর মেয়েদের প্রতি যে সহিংস আচরণ ছেলেদের প্রকাশ পায় সেটিও হয়তো অনেকাংশে কমে যাবে। তাই আমাদের ধর্ষণ কমাতে নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে অধিক সচেতন হতে হবে।

সাদিয়া আফরিন মৌরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

নারী নির্যাতন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের ৭ শতাংশ নারী জীবনের যেকোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

আমার কাছে মনে হয়, ধর্ষণ রোধে সবার আগে যা দরকার, তা হলো মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন! মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দিতে পারে পুরুষশাসিত সমাজ! দরকার যথেষ্ট জ্ঞান, যতটা জ্ঞান না হলে প্রভাবক আর মূল কারণের পার্থক্য বোঝা দায়। একটা মেয়েকে শুধু লালসার চোখে না দেখে, কামনার বস্তু না ভেবে তাকে তার প্রাপ্য পর্যাপ্ত সম্মান দিতে হবে! নারী শুধু ভোগের বস্তু না, নারী একটা সমাজের ঠিক ততটুকুই গুরুত্বপূর্ণ, যতটুকু একটা সমাজে পুরুষরা।

তানিয়া আক্তার বর্ণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমানে সবচেয়ে আলোচনার বিষয় হচ্ছে ধর্ষণ, যা করোনাকালীন সময়ে যেন লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। ধর্ষণকে রুখতে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। যদিও ধর্ষণ নামক শব্দটি পৃথিবী থেকে একেবারেই উৎখাত করা সম্ভব নয়, তবু যথাযথভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটাতে পারলে তা অনেকটাই কমানো সম্ভব। 

ধর্ষণ করেও ধর্ষক আইনের ফাঁক-ফোকঁড় থেকে কোনো না কোনাভাবে বেচেঁ যায়। ধর্ষণকে রুখতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা রোধ করতে হবে। এছাড়াও আমাদের দেশে স্কুল শিক্ষা কারিকুলামে সেক্স এডুকেশন বা যৌন শিক্ষা না থাকায় সমাজ আমাদের নারীদের যেভাবে ভাবতে শেখায়, তাই শিখি। ফলে, সঠিক শিক্ষা না থাকায় নারীর প্রতি সহিংসতাও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। 

পূর্ণতা সাহা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

বর্তমানে আমাদের দেশে করোনার চেয়েও বড় মহামারি হয়ে ওঠেছে ধর্ষণ। তবে ধর্ষণের হার কোনোকালেই বাংলাদেশে বা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে কম ছিল না। ধর্ষণ প্রতিরোধে পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ছেলে-মেয়েদের ছোট থেকেই "proper sex education" এর আওতায় আনতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন শুধু মুখে নয়, বাস্তব জীবনেও প্রয়োগ করতে হবে। নারীদের শুধু "নারী" হিসেবে না, মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। "Spare the road and spoil the child'  অর্থাৎ ‘শাস্তি না দিলে শাসন হয় না’। 

তাই ধর্ষকদের কঠোর বিচারব্যবস্থার আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সব প্রকার সতর্কতা ও সাবধানতা সত্ত্বেও আমরা হয়তো ধর্ষণ পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারবো না, তবে সচেতনতা, সতর্কতা, সামাজিক শিক্ষা ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে পারে।

মোমেনা আক্তার, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ইদানিং নারী ধর্ষণের হার বেড়েই চলছে। খবরের কাগজে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা টিভির পর্দায় চোখ মেললেই হাজির হয় ধর্ষণের খবর।  কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আমরা এখনও এর সুষ্ঠু বিচার পাইনি, কবে পাবো তাও জানা নেই। দেশে ধর্ষণ রোধে বিভিন্ন আইন থাকলেও যথাযথ প্রয়োগের অভাবে ধর্ষকের সংখ্যা বাড়ছে। 

ধর্ষণ রোধ করতে হলে আইনের পাশাপাশি নিজেকে সচেতন করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগে ধর্ষণের পরিমাণ কমলেও পুরোপুরিভাবে দমানো যাবে না। মানুষ তার স্বভাবসুলভ কথায়, চলায়, দৃষ্টিতে ধর্ষক হয়ে ওঠে, তাই নারীকে জাগতে হবে। 

নুসরাত রশিদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমানে ধর্ষণ এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। ধর্ষণ যেন আজ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মহিলারা পর্যন্ত আজ এই নোংরা ও হিংস্র কাজ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এই ধর্ষণ রোধে নারীদের এমনভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যাতে তারা দৃঢ়ভাবে ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার ও সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। 

হোসেনেয়ারা খাতুন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

কোনো ধর্মে ধর্ষণকে সমর্থন করেনি। ইসলামসহ সব ধর্মেই সংযমের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা ও সামাজিক রীতির মধ্যেও রয়েছে তার জোরদার।

কিন্তু কেউই মানছে না এই সামাজিক রীতি-নীতি, ধর্মীয় অনুশাসন। স্কুল-কলেজ, মন্দির- মসজিদ-গীর্জা, রাস্তাঘাট! হচ্ছে না কোথায় এই ধর্ষণ। নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে প্রত্যেকেই অবগত থাকেন। কিন্তু সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান ও পরকাল ভীতি কয়জনের মাঝে আছে? ধর্ষণরোধে বন্ধ করতে হবে পর্নোগ্রাফি সাইট। শারীরিক উত্তেজনা প্রকৃতির নিয়ম। অতি উত্তেজনা সৃষ্টি হলে রোজা রাখতে হবে। উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করতে হবে। 

ধর্ষকের বিরুদ্ধে আইনের যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। নারী আজ কোথাও নিরাপদ নয়। ধর্ষক কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কারণ উদঘাটন করে সমাধান যেমন জরুরি, তেমনি ধর্ষকের যথোপযুক্ত শান্তি নিশ্চিতও জরুরি।

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়