ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলবাসীর সুখ-দুঃখের একজন সঙ্গী ইমরান 

তাসফিয়া তাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৪, ১১ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৪:২৯, ১১ নভেম্বর ২০২০
উপকূলবাসীর সুখ-দুঃখের একজন সঙ্গী ইমরান 

২০ মে, ২০২০ উপকূলবাসীর জন্য একটি জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণ ছিল। কারণ, এদিন উপকূলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সুপার সাইক্লোন আম্ফান। খুলনা জেলার কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের সুন্দরবন উপকূলবর্তী কাঠমারচর গ্রামটি আম্ফানের ধ্বংসযজ্ঞের অন্যতম শিকার। বন্যায় প্লাবিত হওয়ার কারণে এখানকার মানুষ রাস্তার উপরে ছোট্ট টং বেঁধে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন, এখনো করছেন। তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই ও খাবারের তেমন কোনো ব্যবস্থাও নেই। 

নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি এখানে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত ও গর্ভবতী নারীরা আরও ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার। চারদিকে শুধু লোনা পানি থাকার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে আছে এই অঞ্চলের মানুষ।

গ্রামের মানুষের এই চরম দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তরুণ ইমরান। তিনি কাঠমারচর গ্রামের শেখ আমিরুল ইসলাম এবং লুৎফুন্নেসা বেগমের সন্তান। উপকূলে জন্মগ্রহণ করায় ছোটবেলা থেকেই এসব দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি দেখে এসেছেন তিনি। উপকূলে পানির অভাব না থাকলেও নিরাপদ সুপেয় পানির কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। মৎস্য শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় এই উপকূলবাসীরা দুর্যোগের সময় খুবই অবহেলিত ও চ্যালেঞ্জিং জীবনযাপন করেন। উপকূলের নারীদের দুর্যোগকালীন সুরক্ষার বিষয়টি সবসময় অবহেলিতই থাকছে।

যখন ঘূর্ণিঝড় আয়লা হয়, তখন ইমরানের বয়স মাত্র ৯ বছর। সেই ছোট বয়সে ইমরান গ্রামের নারীদের অসহায় অবস্থাটি দেখেছিল। সেই সময় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য ত্রাণের ট্রলার আসতো কিন্তু সেই ত্রাণের মধ্যে নারীদের সুরক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থাই থাকতো না। এছাড়া মানবিক সহায়তা এতটাই কম ছিল যে, অধিকাংশ নারীরা না খেয়ে জীবনযাপন করতেন।’ 

সেই সময়ের বিষাদময় অভিজ্ঞতা থেকে তরুণ ইমরান এখন নারীদের উন্নয়নে কাজ করতে বদ্ধ পরিকর। আম্ফানের তাণ্ডবের পর তার গ্রামের নারীরা যখন এমনই দুর্দশাগ্রস্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন, ঠিক তখনই ইমরান তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইমরানের সবচেয়ে শক্তির জায়গা তার ফটোগ্রাফি। বন্যাকালীন ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে তিনি তার গ্রামের মানুষের ও নারীদের দুর্দশার চিত্রটি ফেসবুকের মাধ্যমে পুরো দেশকে জানাতে সক্ষম হয়েছেন। তার প্রত্যেকটি ছবি ও ভিডিও যেন জীবন্ত হয়ে এসব দুর্যোগ কবলিত অসহায় নারীদের দুর্দশার কথা বলছে। 

দুর্যোগকালীন গ্রামীণ নারীদের সুরক্ষায় ও নারীদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ইমরান ইতোমধ্যেই গ্রামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সংগঠনের মাধ্যমে গর্ভবতী নারীদের সুরক্ষা ও নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়াতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এছাড়া উপকূলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তিনি কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থার কার্যক্রম শুরু করেছেন। তার এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি উপকূলের কিশোরীদের শতভাগ শিক্ষার হার বাড়াতে চান ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে চান।

ইমরান বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগে স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে মানবিক ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইতোমধ্যে ওই অঞ্চলের ১৫০টি পরিবারের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রায় পাঁচ স্তরের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের পাশে থেকেছেন। তার মানবিক সহায়তা কার্যক্রমগুলোতে নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের পাশাপাশি তার মানবিক সহায়তা কার্যক্রমগুলোতে গ্রামের প্রতিটি নারীকে স্যানিটারি ন্যাপকিন দিয়েছেন।

এছাড়া দুর্যোগ কবলিত এসব গ্রামীণ নারীদের সচেতনতার উদ্দেশে তিনি ইতোমধ্যেই এ বিষয়ক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, ফনি ও বুলবুলের সময় তিনি বিভিন্ন সচেতনতামূলক লিফলেট ও দুর্যোগের সিগনাল সম্পর্কে প্রতিনিয়ত তার গ্রামের প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করেছেন। দুর্যোগের সময় অসুস্থ নারী ও বৃদ্ধদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রামের তরুণদের নিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। 

করোনা মহামারির সময়ে তার গ্রামের তরুণদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি গ্রামের দুর্দশাগ্রস্ত গরিব মানুষের পাশে থেকেছেন। প্রতিনিয়তই তিনি গ্রামীণ এসব নারীদের অধিকার ও স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার মতে, বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন সাধিত হতে পারে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এজন্য তিনি গ্রামীণ এসব নারীদের সুরক্ষার পাশাপাশি স্বাবলম্বী করার দিকে জোর দিয়েছেন। তার অঞ্চলে একটি জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজ গঠনের মাধ্যমে নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই তার প্রধান লক্ষ্য। 

ইমরানের তোলা ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে উপকূলে নারীরা কতটা সংগ্রাম করছে, সেটা বোঝা যায়। নিজের পরিবারে সংকট থাকা সত্ত্বেও তাকে কোনো কিছুই আটকাতে পারেনি। লোনা পানির সমুদ্রে বাস করেও তার গ্রামের মানুষের পাশে থেকেছেন ও তাদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বন্যাকবলিত শিশুদের নিয়ে তিনি ফুলকুড়িদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারুণ্য কখনও মাথা নোয়াবার নয়, সেটা বরাবরই প্রমাণ করেছেন ইমরান হোসেন। তারুণ্য শপথে বলিয়ান ইমরান যেন উপকূলের এক অসীম সাহসী যোদ্ধা।

লেখক: শিক্ষার্থী, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়