ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে?

আরমান শেখ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৩, ১২ নভেম্বর ২০২০  
বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে?

বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নতুন প্রার্থীর বিজয় বিশ্বনেতৃত্বে সৃষ্টি করেছে একাধারে আশার আলো, অস্বস্তি ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। মার্কিন মুল্লুকের নতুন কর্ণধারের আচরণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বিশ্ব মিডিয়াগুলো এখন সরগরম। এর অন্যতম কারণ বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সংকট ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন।

বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাঠ তথা মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান শক্তি ইরান ও তুরস্কের প্রতি বাইডেন কী ধরনের ভূমিকা রাখবেন তা এখন অনেকেরই চিন্তার বিষয়। এতদিনের সব জল্পনা-কল্পনার পর সম্প্রতি সিরিয়া বিষয়ক মার্কিন দূত জেমস জেফরি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তুর্কি বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিকেকে-কে সিরিয়া থেকে সরিয়ে নেবে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অজুহাত দেখিয়ে গেরিলা গোষ্ঠীটির সমর্থন বন্ধ করার কারণস্বরূপ তিনি বলেন, এই গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়ার করণে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, যা পুনরুদ্ধার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

বাইডেনের ক্ষমতায় আসার পরপরই এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চিত মার্কিনিদের নতুন তুরস্কনীতির ইঙ্গিতই বটে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা যায় সিরিয়ায় তুরস্কের সহায়তা নিয়ে মার্কিনিদের নতুনভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি ও রাশিয়াকে চাপে ফেলা। আর এই উদ্দেশ্য পাকাপোক্ত করতে মধ্যপ্রাচ্যের অপর শক্তি ইরানকেও শান্ত রাখতে পরমাণু চুক্তি নবায়নের চিন্তা করছেন বাইডেন।

ইতোমধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল প্লেটকাসহ অনেকেই বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি ইরানঘেঁষা ও সৌদি বিমুখ হতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন। সম্প্রতি দেখা গেছে, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছে। 

তবে ইরানঘেঁষানীতি গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করতে ইজরাইলের অভিবাসন মন্ত্রী হানেগোভি তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, বাইডেনের ইরানঘেঁষানীতি ইরান-ইজরায়েলকে সহিংতার দিকে ঠেলে দেবে। কিন্তু ইজরাইলি ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ডিফেন্স কমিটির চেয়ারম্যান জোভেভি বলেন, ওবামার সময় বাইডেনকে দেখেছি, তিনি ইজরাইলের একজন পরীক্ষিত বন্ধু। যদি পরমাণু চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে তা আগের থেকে অনেক বেশি কার্যকরী হবে।

এর প্রেক্ষিতে ধারণা করা যায়, পশ্চিম তীরের বসতি স্থাপন নিয়ে বাইডেনের আপত্তি থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে ইজরাইলি শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে মার্কিননীতি অব্যাহত রাখবে তার সরকার, যা সাম্প্রতিক সময়ে আমিরাতসহ অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইজরাইলি চুক্তিতে বাইডেনের সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে বোঝা গেছে।

অপরদিকে ইয়েমেনে আগ্রাসন পরিচালনায় সৌদি জোটে মার্কিন সমর্থন হ্রাস করার মতো নতুন কর্মসূচি আসতে পারে ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়া ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আনলে, নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে ইয়েমেনে ইরানি সমর্থনপুষ্ট হুথিদের বিরুদ্ধে সৌদি আগ্রাসনে বাইডেনের সহায়তা হ্রাস পাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেনের ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের হেতু হিসেবে উল্লেখ করা যায় রাশিয়াকে চাপ দেওয়া ও সিরিয়ায় নতুন অবস্থান সৃষ্টি করে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, যা এখন অনেকটা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। লিবিয়া ও চলমান আজারবাইন যুদ্ধে মার্কিনিদের দর্শকের ভূমিকা ও রাশিয়ার সক্রিয়তা আঞ্চলিক রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টি করেছে বৈকি। তাছাড়া আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধেও মধ্যস্থতাকারী বা অন্য যেকোনো ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে না রাশিয়া ও তুরস্ক কেউই। 

সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্টের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জানা গেছে, রবিবার (৮ নভেম্বর) রাতে এরদোগান ও পুতিনের সরাসরি ফোনালাপ হয়, যেখানে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়ন বিষয়ক আলোচনাসহ আজারবাইজান যুদ্ধের ব্যাপ্তি ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাশিয়াকে তুরস্ক আশ্বস্ত করেছে। যদিও গতকাল আজারি বাহিনী কর্তৃক ভুলবশত রাশিয়ার মিগ-২৪ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনার প্রেক্ষিতে রাশিয়া ‘পিস কিপিং মিশন’ নামে চুক্তি অনুযায়ী সংঘাত নিরসনে সীমান্তে সেনা মোতায়েন করবে বলে জানিয়েছে। তবে এই মিশনের উদ্দেশ্য হিসেবে ধারণা করা যায়, যুদ্ধের ভয়াবহতা হ্রাস ও মাঠপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টির মাধ্যমে ককেশাস অঞ্চলে নিরপেক্ষভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখা।

উপর্যুক্ত ঘটনাবলীসহ সিরিয়া, লিবিয়া ও আজারবাইজানে তুরস্ক-রাশিয়ার কৌশলি ভূমিকার মাধ্যমে নিজেদের সম্পর্ক রক্ষাকরণ থেকে বোঝা যায় যে, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো নেতা তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ কেউই চায় না।

তবে বিশ্ব রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প আমলের ভরাডুবি থেকে পুনরুত্থান ঘটাতে বাইডেন নিতে যাচ্ছেন নতুন কর্মপরিকল্পনা। মধ্যপ্রাচ্যের ‘ইসলামিক সেন্টিমেন্ট’কে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার লাগাম টানতে বদ্ধ পরিকর তিনি। গতকাল নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হেরিস ট্রাম্পের কথিত ডিল অব সেঞ্চুরি থেকে বের হয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, তার সরকার কোনোভাবেই ট্রাম্পের একপেশে নীতি সমর্থন করবে না, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আবারও শান্তি আলোচনা শুরু করবে বাইডেন সরকার। বন্ধ করে দেওয়া ফিলিস্তিনি ত্রাণ কার্যক্রমও পুনরায় শুরু করবে তার সরকার।

একইভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনকে কোণঠাসা করতে বাইডেন একক ভারতের উপরে নির্ভরশীল না হয়ে পাকিস্তানকেও সঙ্গে পেতে তাঁর অর্জিত পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘হেলাল-ই-পাকিস্তান’কে কাজে লাগাতে পারেন। ট্রাম্পের পাকিস্তান বিমুখ নীতি থেকে সরে আসার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিও সম্প্রতি শুরু হওয়া মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করবেন বাইডেন।

নতুন মার্কিন কর্ণধার কতটা ঠান্ডা মাথার দাবাড়ু তা ওবামা আমলে বিশ্বনেতারা দেখেছেন বলেই হয়তো এখনো চীন ও রাশিয়া তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শুভেচ্ছাবার্তা পাঠায়নি। । ট্রাম্প হুমকি-ধমকি ও অবরোধে বিশ্বাসি হলেও বাইডেন অনেকটা কাজের উপর বিশ্বাসি বলেই ধারণা করা হয়। 

তবে আপাতদৃষ্টিতে প্যারিস চুক্তিসহ বিশ্ব সংস্থায় বাইডেনের ফিরে আসার মতো শান্তিমূলক সিদ্ধান্তগুলো বিশ্বে শান্তির পূর্বাভাসই দিচ্ছে। আশাকরছি বাইডেন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যোগ্য নেতৃত্বের আসনে নিয়ে আসার মাধ্যমে বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ-সংঘাত হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। 

চবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়