ব্যস্ততার ছকে গাঁথা ‘ইবি রিপোর্টার্স ইউনিটি’
শাহীন আলম || রাইজিংবিডি.কম
গল্পটা যেন ঠিক আঁকা একটি ছবির মতো। কোথাও হালকা সবুজের আলতো আঁচড় কোথাও আবার গাঢ় লালের দীর্ঘ প্রলেপ। সেই লাল থেকে যেন ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পরছে ভাষা শহীদ আর মুক্তিযোদ্ধাদের তাজা রক্ত। সবুজ জমিনের উপর অগণিত লাল ফোঁটায় চিত্রিত হয়েছে আশ্চর্য এক মোহনীয় নকশা। যেন এই চেয়েছিলাম আমি।
হোক না সেই প্রাপ্তি হারানোর, হোক না সেই অর্জন বেদনার কিংবা নববধূ আর শিশুর আর্তনাদের। কেন নয় আমি আজ কথা বলছি প্রাণ খুলে, গান ধরেছি সীমাহীন আনন্দে, কবিতার স্তবকে অনায়াসে লিখে যাচ্ছি প্রতিবাদের গল্প, অনুসন্ধানী চোখে তুলে ধরছি রাঘব বোয়ালের অন্তঃপুরের কাহিনী। ক্যামেরার তীক্ষ্ণ যান্ত্রিক লেন্সে ফ্রেমবন্দি করছি আনন্দ, হাসি, কান্না, বিষন্নতা কিংবা উত্তাল রাজপথ।
কবি হলে হয়তো অল্প কথায় ব্যক্ত হতো নিজের না বলা সব কথা, সব অব্যক্ত অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়-
‘‘অনেক কথা যাও যে বলে
কোনো কথা না বলি।’
তবে আমি কবি নই বলেই হয়তো দীর্ঘ বচনই ভরসা আমার ভাবের প্রকাশে। কিন্তু একজন সাংবাদিকও যে একজন কবি, একজন সাহিত্যিক, একজন গল্পকার, তা আমি মেনে নেই বিনা তর্কে ও বিনা শর্তে। তবে এই কবিরা কখনো অলীক গল্প লিখে না। লিখে যায় জীবনের ধারাবাহিক কার্যবিবরণ।
আমি আজ বলবো সেই সাংবাদিকেরই গল্প, বলবো একটি সাংবাদিক সংগঠনের গল্প। প্রশ্ন হতেই পারে মিডিয়া যাদের হাতে, তাদের গল্প আর নতুন করে বলার কী আছে? কিন্তু না, বিষয়টা অনেকটা কলম আর কাগজের মতো। কলম দিয়ে কাগজে লেখা হয় ঠিকই, অথচ কলমের গল্পটা কখনো লেখা হয় না। সাংবাদিক আর সংবাদপত্র তেমনই একটি নিবিড় অথচ জটিল সম্পর্কের সত্তায় নিবদ্ধ।
সাংবাদিকতা শব্দটা বহুলাংশে সেই সবুজ আর লাল রঙের সমসত্ত্ব মিশ্রণ বলা যায়। সবুজকে যদি ধরা হয় সরল রেখার কোনো কুসুমাস্তীর্ণ পথ! তবে গাঢ় প্রলেপ নিঃসন্দেহে জীবনসংশয়ী টাইম ট্যানেল। যে পথের বাঁকে তাজা বারুদ হাতে দাঁড়িয়ে আছে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো শত্রু। অথচ একজন সাংবাদিকের সেই পথ মাড়িয়ে যেতে হয় নির্ভয়ে। কাজ করতে হয় সংবাদের তাগিদে। আর সেই সংবাদটাই তার প্রাপ্তি। যা পৌঁছে যায় সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের দেশে। যে সংবাদে ওঠে আসে বাস্তব জীবনে গল্প। ছাপা হয় সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা দেখানো হয় টিভির পর্দায়।
‘সত্য প্রকাশে মুক্ত কলম সৈনিক’ মূলমন্ত্রে ব্রতী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী সাংবাদিক সংগঠন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটি তেমনই একটি নাম। ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে সংগঠনটি। ইতোমধ্যে ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর দীর্ঘ দুই বছরের পথচলা পূর্ণ করছে ইবি রিপোর্টার্স ইউনিটি। তরুণ এই সাংবাদিকের দলটি দুই বছর ব্যবধানেই প্রমাণ করে দিয়েছে কাজের গতি, স্বচ্ছতা ও সততায় আস্থা থাকলে সফলতা অনিবার্য। অদম্য স্পৃহার সাথে সত্যের সন্তানে ব্রতী হলে সময়সাপেক্ষ হলেও বিজয় সুনিশ্চিত।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবু সালেহ শামীম, সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আহমেদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ইবি রিপোর্টার্স ইউনিটি'র পথচলা। সেই থেকেই গুটিগুটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, যোগ্য নেতৃত্ব আর কঠোর পরিশ্রমে বৃদ্ধি হয়েছে কলেবর। ইবির গণ্ডি পেরিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে পরিচিতি পেয়েছে উজ্জীবিত তরুণদের এই সংগঠন।
সময়ের চাহিদায় প্রগতিশীলতার চর্চা যেখানে মূখ্য, সেখানে পিছিয়ে থাকাটা অনেকটাই বোকার স্বর্গে বাস করার মতো। তাই তো প্রগতিশীলতার চর্চায় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে ইবি রিপোর্টার্স ইউনিটি। ১৭৫ একর প্রাঙ্গনে একটা সময় নারী সাংবাদিকতা শব্দটাই যেখানে ছিলো দুরূহ। সেখানে এই সাংবাদিক সংগঠনটি হলো নারী সাংবাদিকতার রোল মডেল। বৈষম্যের শেকল ভেঙে নারী সাংবাদিকতার স্তম্ভকে করেছে দৃঢ় ও শক্তিশালী। একাধিক নারী সাংবাদিক কাজ করে চলছে সমান প্রতিযোগিতায়। নিজের যোগ্যতা এবং দক্ষতায় তারা জায়গা করে নিয়েছে কার্যনির্বাহী পরিষদ কমিটিতে।
বছর পূর্তির প্রান্ত লগ্নে সাংবাদিক সংগঠনটি পেয়েছে নতুন আরেকটি কার্যনির্বাহী কমিটি। গত ১০ নভেম্বর এই প্রথম গঠিত হয় কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত কমিটি। দৈনিক আমাদের নতুন সময় এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মুরতুজা হাসান ও দৈনিক খবরপত্র এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সাব্বির আহমেদ নির্বাচিত নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। নতুন এই কমিটিকে ঘিরে রয়েছে শত নতুন স্বপ্ন। তারুণ্যে স্পৃহা যেখানে একনিষ্ঠ সেখানে তারা এগিয়ে যাবেই বলে বিশ্বাস করে নেতৃত্বে আসা নতুন মুখ।
তবে আজ যেন এই তরুণদের মনে আষাঢ়ের কালো মেঘের ঘনঘটা। একটা তীব্র বিষাদ আঁকড়ে ধরেছে তাদের। বৈশ্বিক দুর্যোগে করোনার অসহ্য অবসরটাই যেন আজ তাদের অবসাদের মূল কারণ। কর্মহীন জীবনে হাঁপিয়ে গেছে উদ্যমী তরুণেরা। একদিন যাদের ব্যস্ততা ছিল প্রত্যহিক, সংবাদ সংগ্রহের তাগিদ ছিল অফুরন্ত, সেখানে আজ অঢেল অবসর। তাই তো পুনরায় আপন আলয়ে ফেরার অপেক্ষায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে তারা।
তাছাড়া প্রিয় সংগঠনের জন্মদিন অথচ অনাড়ম্বর ভাবেই কাটবে তাদের দিন। সে যেন তাদের মনের একটি তীব্র আর্তনাদ। প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মৃতিটাই আজ তাদের অতীত অসুখ। সেখানে ছড়িয়ে আছে একটা সোনালী অতীত। মনের গহীনে স্মৃতিবিজড়িত পৃষ্ঠা জোরে কবির কল্পনার থেকেও সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বরের গল্প।
দিনটি ছিল রূপকথার রাজ্যের গল্পের থেকেও সুন্দর। অসীম আনন্দ আর সীমাহীন কৌতুহল জানান দিচ্ছিল প্রতিটি সদস্যের চোখে ও ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসিতে। আনন্দ শোভাযাত্রায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আনন্দ উৎসবে সামিল হয়েছিলেন তৎকালীন ইবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারু-উর-রশিদ আসকারী, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান, প্রোক্টর অধ্যাপক ড. পরেশ চন্দ্র বর্ম্মন, ঝিনাইদহ জেলার ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি বিমলসাহ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শোভাযাত্রা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে একটি আলোচনার আয়োজন করা হয়। এসময় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেক কাটেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুণ-উর-রশিদ আসকারী, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সেলিম তোহা এবং রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এস.এম আব্দুল লতিফ। আলোচনা সভা শেষে একটি মনোগ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। তবে করোনা প্রকোপের কারণে দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে অফলাইনে কোনো অনুষ্ঠান করতে না পারলেও অনলাইনে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে ইবি রিপোর্টার্স ইউনিটি।
ইবি রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রতিটি সদস্যকে ভ্রমণ পিপাসুও বলা যায়। তারা সময় এবং সুযোগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রায়শই হারিয়ে যায় প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। কখনো প্রমত্ত পদ্মার বুকে নৌকো ভাসায় তরুণ নাবিকের দল হয়ে। কখনো পৌঁছে যায় দূর বহুদূরে সাগর কন্যার দেশে। এই তো গত শীতের কথা সকলে মিলে যাওয়া হলো কুয়াকাটার সৌন্দর্যের রহস্য উন্মোচনে। সে এক অনবদ্য স্মৃতি। সাগর তীরে ফুটবল খেলা, লাল কাঁকড়া ধরার বৃথা চেষ্টা, ঝিনুক কুড়ানো, সকলে মিলে সামুদ্রিক মাছ খাওয়া আজ যেন সবই অতীত।
করোনার ভয়াল থাবায় সেই পরিচিত ভুবন ছেড়ে আছি বহুদূরে। যেন এক শতাব্দী হলো দেখা হয়নি প্রিয় মুখগুলো। হাজারো জমিয়ে রাখা গল্প বলা হয়নি বহুদিন। ক্যামেরা কাঁধে দৌড়ানো হয়না সংবাদের জন্য। নির্ঘুম রাত কাটানো হয়নি একটি সংবাদ আসার কথা সেই প্রতীক্ষায়। অথচ আমি ছুটে যেতে চাই, ফিরে যেতে চাই আমার পুরনো ব্যস্ততায়। আমি আবারো লিখতে চাই সংবাদপত্রের পাতায়। নিজের লেখা হাতে নিয়ে নিজেই পড়েতে চাই বারবার। মনে মনে বলতে চাই, এটা আমি লিখেছিলাম। কিন্তু কোথায় আমার পুরনো সেই প্রিয় ব্যস্ততা?
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
ইবি/মাহি
আরো পড়ুন