ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একজন বাংলাদেশি চায়না শিক্ষক ড. আলতাব

শেখ নাসির উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৭, ২৩ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:১১, ২৩ নভেম্বর ২০২০
একজন বাংলাদেশি চায়না শিক্ষক ড. আলতাব

‘মানুষের জন্ম হয় সফলতার জন্য, ব্যর্থতার জন্য নয়’ দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরোর এই উক্তি যেন যাথার্থ বাংলাদেশি গবেষক মো. আলতাব হোসেনের ক্ষেত্রে। ইউনিভার্সিটি অব ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়নার এই গবেষক তৈরি করেছন ‘স্মার্ট চায়না শিক্ষক’ নামের চায়না ভাষা শিক্ষার ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রোগ্রাম।

তার ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রোগ্রামের জন্য সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত চেংদু-ছংছিং বৈদেশিক শিক্ষার্থী অর্থনৈতিক বৃত্ত (Chengdu-Chongqing Economic Circle Competition for International students) প্রতিযোগিতায় ৬০টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এর আগে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক সিস্টার সিটি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ইনোভেশন প্রতিযোগিতায়ও তার নির্মিত ওয়েবনির্ভর চীনা ভাষা শিক্ষার সফটওয়্যার (cnpinyin.com) প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। 

সাফল্যের এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। শত বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া এই মানুষটি কখনো ভাবতেও পারেননি তিনি একদিন চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন।

প্রত্যন্ত জেলা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার চেংঠী হাজরাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেংঠী গ্রামে আলতাফ হোসেনের বাড়ি। বাবা মাদ্রাসা শিক্ষক মো. আতাউর রহমানের সংসারের চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি।

সংসারের অভাব অনটনের মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। ছোটবেলা থেকেই বেশ মনযোগী ছিলেন পড়াশোনায় আর মেধা তালিকায় প্রথম সারিতে থাকতেন সবসময়। শৈশবের দিনগুলোতে খেলাধুলার সময় খুব কম পেয়েছেন। কখনো ধান কাটা অথবা বেগুন, ভুট্টা আর বাদাম ক্ষেতের পরিচর্যা আর গরুকে মাঠে নিয়ে গিয়ে কেটে গেছে সোনালী শৈশব।

এইচএসসিতে ভালো ফলাফলের জোরে ঝাড়বাড়ী কলেজ থেকে ২০০৬ সালে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সুযোগ পান। এরপর ২০০৮ সালে চীনের একটি প্রতিনিধি দল হাবিপ্রবিতে গেলে সেখানে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম থেকে তাকে চীনে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়। সুযোগ হাত ছাড়া করেননি, সেই বছরই চীনের শেন ইয়াং ইউনিভার্সিটি অব কেমিক্যাল টেকনোলজি গিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ করেন। 

তারপর ইউনিভার্সিটি অব ইলেক্ট্রনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়নায় মাস্টার্স শেষ করে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি করেন। আর এখন তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক। তিনি তার কর্মজীবনে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড ওয়ালটন গ্রুপের গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকৌশলী ও চায়না অফিসের প্রধান প্রতিনিধি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশি সফল গবেষক আলতাব হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি চীন দেশে আছেন।  

তিনি বলেন, ‘‘দুঃখ-কষ্ট জীবনের অংশ। খারাপ সময় ব্যতিত ভালো সময় কখনো আসবে না। সবসময় আমাদের নিজের কাজ ভালোভাবে চালিয়ে যাওয়া উচিত। সাফল্যের শেষ নেই, তাই এখনো নিজেকে সফল দাবি করি না। যদিও এখানে আসতে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।

ছয় সদস্যের পরিবারে চার ভাই বোন পড়াশোনা করতো, তাই অভাব-অনটন লেগেই থাকত। পড়াশোনার ফাঁকে খুব কম সময় পেয়েছি খেলাধুলার জন্য। অবসর সময় ক্ষেতের শাক সবজি তুলতাম। আমাদের ওইখানে সন্ধ্যাবেলা বাজার বসত, বিকেলে তোলা শাক-সবজি ও গাভীর দুধ নিয়ে বাজারে বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি।

এত কিছুর পরেও সবসময় ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় থাকতাম। পরিবার সবসময় আমার পাশে ছিলেন বলে এগিয়ে গিয়েছি। এরপর এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে দিনাজপুর হাজী দানেশে পড়ার সময় ভার্সিটিতে চায়না থেকে একটা দল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম করে। আমি আর আমার বন্ধু সেখানে চায়নায় পড়াশোনা করার অফার পাই। তখন পরিবার আমাকে চায়নায় পাঠিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় আজকে আমি চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

বিদেশে থাকলেও দেশের জন্য মন কাঁদে আর তাই সময় পেলে আমি দেশে চলে যাই। করোনার জন্য অনেক দিন হয়ে গেলো দেশে যেতে পারছি না। পরিস্থিতি ভালো হলে অবশ্যই দেশে গিয়ে ঘুরে আসবো।’’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘স্মার্ট চায়না শিক্ষক প্লাটফর্মের প্রোগ্রামে বাংলা সংস্করণ যোগ করতে চাই। যাতে বাংলাদেশিরা খুব সহজে চায়না ভাষা শিখতে পারে। স্মার্ট চায়না শিক্ষক আরও আপডেট করার মাধ্যমে অনেক প্রোগ্রাম যোগ করে বিশ্বের বুকে সবার হাতে হাতে পৌঁছে দিতে চাই। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে আরও বেশি মর্যাদার আসনে বসাতে চাই। আমার চলমান গবেষণা, চায়নায় কাজের অভিজ্ঞতা ও গঠনমূলক কাজগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাই।’’

লেখক: শিক্ষার্থী, ছাফদার আলী কলেজ, মির্জাপুর।

টাঙ্গাইল/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়