ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

পরান পাখি উড়াল দিলে...

বঙ্গ রাখাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ২৮ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১১:৪১, ২৮ নভেম্বর ২০২০
পরান পাখি উড়াল দিলে...

দিন দিন পরিচিত মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। নিজের আপনজনেরাও কেমন যেন হারানোর লাইনে নিজেকে সামিল করে তুলেছে। যখন ছোট ছিলাম-কেমন আমাদের মধ্যে-এক ধরনের মায়া মমতায় ভরপূর ছিল। এখন সেই সম্পর্কেও মনে হয় ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। মানুষ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি তার মায়া-মমতার জায়গাটাও কমতে শুরু করে নাকি করে না তা জানতে পারি না। 

একদিন সবাই কত হৈচৈ করতাম সারাবাড়ি মাতিয়ে রাখতাম, যে সম্বল ছিল আমাদের কাকু, ফুফু, বাবা, মা, ভাই -বোন তাদের লাইনেও আজ বিপর্যয়ের সংকেত। আমাদের বাড়িটা বড় হওয়ার কারণে আমরা সবাই একসঙ্গে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমরা যেমন সবাই সবাইকে ভালবেসেছি, তেমনি সবাইকে ভয়ও করেছি। বাবারা সাত ভাই, দুইবোন। আমাদের বাড়িতে কখনো কেউ মারা যাবে একথা তো কোনো দিন ভাবতেই পারিনি বা কল্পনাতেও কোনো দিন আসেনি এ বাড়ির কেউ কোনো দিন আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমাবে অজানাতে। তবুও একদিন সেই কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়েছি। 

প্রথমে আমার দাদার মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছে। দাদাকে ঘরের বারান্দায় শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। আমরা যারা বাড়ির মানুষ, তারা ক্রমান্নয়ে দাদার মুখে গ্লুগোজের জল দিয়ে গলা ভিজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ দাদার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, যে কারণে তার গলা ভিজিয়ে দেওয়া হচ্ছে বারবার। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে তার কণ্ঠ। কণ্ঠস্বর রুষ্ঠ হয়ে সেখান থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। এভাবে দাদার মৃত্যু দেখলাম। এবার কলেজে পড়া অবস্থায় অর্থ্যাৎ দাদাকে ছোটবেলায় মৃত্যু দেখলেও কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু বড়বেলায় এসে বাবার মৃত্যুকে দেখেছি, একেবারেই বাবার শিহরে বসে। কাকু, মা আর আমি। সেই মৃত্যু... বাবার মুখ মলিন... কিন্তু খুলনাতে বাবার মৃত্যুর কাছাকাছি থেকেও জীবনে মেনে নিতে পারিনি বাবার মৃত্যুকে। কারণ তখনো আমার মনে হচ্ছে বাবা কথা বলছে আর চোখের জলে বলছে বাবা কেঁদনা আমি ভালো হয়েই ফিরব। দেখো, মিলিয়ে নিও। 

সত্যিই তো বাবার ভালো হওয়া আমাদের দেখা হলো। তিনি ভালো হয়েই ফিরলেন নিজের বাড়ি, নিজের ঘরে তবে আমাদের সঙ্গে নয়, নিজে এক অন্য রকম পরিবেশে অন্যরকম সঙ্গীহীন হয়ে নিজেই ঝোপের কোণে, অন্ধ ঘরে... মেজ কাকুর মৃত্যুও আমার হাতের উপরে হয়েছিল। বাড়িতে থাকা অবস্থায় ঘুমে বুদ হয়ে আছি, রাতে কার ডাকে আচমকা ওঠে বাড়ির উঠানে লোকে লোকারণ্য মেজকাকুকে ঘিরে সবাই পানি ঢালছে, সবাই সবার মতো করে চেষ্টা করছে কেউ তাকে যমের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারছে না। তবুও আনার ব্যাকুল চেষ্টা। আমরা কয়েকজন মিলে ভ্যানে করে পাশের গ্রামে কাকুকে নিয়ে যাচ্ছি ভ্যানের উপরই কাকুর নিথরদেহ। শ্বাস নাই, কথা নাই, নাড়ি ধরেও বোঝার চেষ্টা করে তাকে কোনো ভাবেই বুঝতে পারলাম না তিনি বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন। 

সবাই কাঁদছে... কাকুর সুঠামদেহের কোথাও তো যমদূতের কোনো চিহ্ন নাই, তবে কোথায় থাকেন তিনি কী করেই বা মানুষের পরানপাখি নিয়ে উড়ে যান। ডাক্তার নাড়ি টিপে জানালেন বেঁচে নেই, এভাবেই চোখের সামনে মেজকাকুও বিদায় নিলেন। দাদীকে অনেক দিন দেখা হয় না-থাকিতো অনেক দূরে ভিন্ন শহরে মন চাইলেই বাড়ির পানে যেতে পারি না, নানা ব্যস্ততা ঘিরে থাকে চারপাশ। ফোন- দাদি মারা গেছেন- আমি আর আনোয়ার ভাই ঠিকঠাক করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম-নদীও পার হলাম। দীর্ঘ পথ...ফেরিতে থাকতেই ফোনের পর ফোন মাটি দিতে চান দাদিকে। অনেক দিন ভুগেছেন আর এমনিতেই বয়স হয়ে গেছে... শেষে সিদ্ধান্ত হলো মাটি দিয়ে দেবে, কারণ আমাদের যেতে আরও অনেক সময় লাগবে এভাবে ফেলে রাখা সম্ভব না। 

দাদির বিদায়ের মুখটাও সেদিন দেখা হয়নি। দাদিজান আমার অনেক সুন্দর করে ডাকতেন নাম ধরে... বাড়িতে গেলেই দাদির ঘরে আগে গিয়ে দেখা করে আসতাম। পরে দাদি ডেকেও অনেক দুঃখ-সুখের গল্প করতো। মায়ের কষ্টের কথা, বাড়ির কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করতো। হায় দাদিজান...গত ২৬.১১.২০২০ রাত ১২টার সময় ফোনে আনোয়ার ভাই জানালেন সোহান খান (ছব্দুল) কাকু মারা গেছে...শুনে ঘুমাতে পারিনি। সারারাত কাকুর স্মৃতি মন্থন করেছি। কাকু ঝিনাইদহে থাকার কারণে সম্পর্কটা সেভাবে ছিল না। কিন্তু সম্পর্কটা গভীর হতে থাকে আমি এসএসসি পাস করার পর থেকে। পাস করার পর থেকে কাকু আমাকে খুব ভালোবাসতো পড়ালেখার খোঁজ-খবর নিতে থাকত। অনেক পড়ামর্শ দিতো। বাবা মারা যাওয়ার পরে কাকু মাকে বলেছিল-বাবুকে ঢাকাতে পাঠিয়ে দেও অনেক ভালো কিছু করতে পারবে। মা শুনেই কেঁদে ফেলে আঁচলে মুখ ঢেকে বলেছিল-ওকে ছেড়ে আমি কী করে থাকবো। তখন কাকু বলেছিল-তাইলে ও এখানে থেকে কিছুই করতে পারবে না। পরে তার কথা মতোই ঢাকাতে চলে এসেছি ও নিজের কাজ করছি। যখন আমার প্রবন্ধের বই ‘সংস্কৃতির দিকে ফেরা’ বইটা দিয়ে ছিলাম তখন কাকু তা মনোযোগ দিয়ে পড়ে আমাকে ফোন করে বলেছিল-বাবু তোমাকে পিএইচডি করতে হবে। অনেক কথা হয়েছিল আমার পড়ালেখা নিয়ে। শুধু আমার পড়ালেখাই না বাড়ির সবার পড়ালেখার খবর তিনি রাখতেন ও এই বাড়ির ছেলে-মেয়েরা ভালো কিছু করুক তিনি হৃদয় দিয়ে তা চাইাতেন। 

কাকুর একটাই মাত্র ছেলে মাহাথির। মাহাথির আমাদের ছোটভাই। ও আমাদের পেলে কেমন যেন পাগল হয়ে যায়। ওহ আজ আমাদের সারিতে এসে দাঁড়ালো। কোনো দিন মাহাথির ভাবতেও পারেনি ওর বাবা এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। নিজের বাবার খাটলা নিজের কাঁধে কতটা কষ্টের যে বহন করে সে ছাড়া হয়তো কেউ এর সঠিক জবাব দিতে পারে না। অনেক অভিমানী তুমি কাকু-যেখানে তোমার বড় ভাই, মেজ ভাই আর মা ঘুমায় সেখানে থাকতে চাওনি, থাকলে নিজের বাড়ির কাছে-যেখান থেকে নিজের কলিজা, নয়নের মণি, সাতরাজার ধন পুত্র মাহাথিরকে যেন দেখতে পারো... আমিও হয়তো একদিন নতুন নতুন ডিগ্রি অর্জন করবো, সবাই অনেক ডিগ্রিধারী হবে, কিন্তু কাকু তুমি... সেই গহীন অন্ধকারে নিজেকে ঘুটঘুটে ঘরে আবদ্ধ করে রাখবে। 

মাহাথির বড় হচ্ছে। মুক্তি-সংগ্রামের সেই বাসায় একজন দুঃখীনি বালিশ বুকে চেপে ধরে প্রতিদিন চোখের জলে রাত পার করছে। কত কাঁদলে তুমি ফিরবে বলতে পারো কাকু... তোমার বিদায় বেলায়- মুখটাও দেখতে পারিনি, সে ব্যথা বুকেই রাখি তবুও মাথায় একটাই চাপ কাকু চলে গেলো। এই কাকুকেই একদিন নিজের জীবনের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে বুকের কাছে আগলে রেখেছিলাম হাসপাতালে হাসপাতালে। 

অভিমানী কাকু অভিমান থাক তোমারই, আমরাও রাখি কষ্ট, বলতে পারছি না কাকু আসেন না একবার আর বাবু, মাহাথিরদের বুকে করে চলেন সবাই এক হয়ে পথচলি। আমাদের অনেক দূরে যেতে হবে, চলেন না সবাই মিলেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেই। একা তো অনেক কষ্ট-বেশি দূরে যাওয়া যায় না...

লেখকঃ কবি ও গল্পকার।

ঢাকা/শান্ত/মাহি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়