ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ক্যারিয়ার প্ল্যান-ক্যারিয়ার সাকসেস 

অরুণ কুমার বিশ্বাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৮, ২ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৪:৩৩, ২ ডিসেম্বর ২০২০
ক্যারিয়ার প্ল্যান-ক্যারিয়ার সাকসেস 

গোড়াতেই বলে রাখি, সাকসেস মানে হলো ‘পিস অব মাইন্ড’ বা মনের শান্তি। যে কাজ করে মনের শান্তি মেলে না, উল্টো মন শাস্তি পায়, তাকে আমি অন্তত কাজ বলি না, সেটা একরকম পানিশমেন্ট বলতে পারেন। তাই যারা বলে থাকেন, কাজ মানেই কাজ, তাদের সঙ্গে আমি মোটেও সহমত নই, আমি ভিন্নমত পোষণ করি। কেননা, আমি শিক্ষকতার চাকরি পেলে নিশ্চয়ই রাস্তা ঝাড় দেবো না, বা পলিসি মেকিংয়ের সুযোগ পেলে গ্যারেজে কাজ করবো না। ইটস ভেরি সিম্পল অ্যান্ড ক্লিয়ার।

তার মানে এই নয় যে, আমি কোনো কাজকে খাটো করছি। কারণ আমি জানি প্রতিটি কাজই দরকারি, তবে সেটা হয়তো আমার বা আপনার জন্য নয়। করোনাকালীন সময়ে বেশ বুঝতে পেরেছি সেলুনশিল্প কত দরকারি। থাক সেসব কথা। আমি ক্যারিয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বলছিলাম।

মাঝে মাঝে মনে হয় ‘ক্যারিয়ার’ শব্দটি কিছুটা নেচিবাচক শব্দ। এখানে একরকম ইঁদুরদৌড়ের গন্ধ পাওয়া যায়, যেন মনের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণার মতো। যখন আমরা ক্যারিয়ার সাকসেসের কথা বলি, তখনও মনে হয় এ যেন অনেকটা সোনার পাথরবাটি কিংবা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো। ক্যারিয়ার গড়বেন, সাফল্যের মইয়ে চাপবেন, আবার প্রকৃত অর্থে সাকসেসও হবেন (অর্থাৎ মনের শান্তি)-আদৌ কি তা সম্ভব! কিছু উদাহরণ দিয়ে বলি, তাহলে হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। 

কেস স্টাডি-১

রহমান সাহেব উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও চৌকস। তিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়েছেন, তারপর আবার ব্যবসা প্রশাসনেও মাস্টার্স করেছেন। যাকে বলে গুড কম্বিনেশন। তিনি খুব ভালো বাংলা ও ইংরেজি জানেন, যেকোনো বিষয়ে তার যৌক্তিক বিন্যাস ও উপস্থাপনা সত্যি অসাধারণ। তিনি তার চাহিদামতো একটা চাকরিও পেলেন, করপোরেটে। প্রথম দিকে বেশ চলছিল, কিন্তু তিনি বিয়ে করবার পরেই আসল সমস্যা শুরু হলো। তিনি যেহেতু সবকাজের কাজি, তাই তাকে ছাড়া অফিস অচল। সিনিয়র কর্তারা সব কাজে রহমানকে ডাকেন, তিনিও বসের মনোরঞ্জনের জন্য ঊর্ধ্বমুখে ছুটতে থাকেন। তাতেও তার খুব একটা আপত্তি ছিল না। 

কিন্তু নবপরিণীতা বধূ রহমানকে চায়, সে চায় তার স্বামী যেন ৬টার মধ্যে বাসায় ফিরেন, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। রহমানের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯-১০টা বেজে যায়। আবার কখনও বা ছুটির দিনেও অফিস করতে হয়। প্রসঙ্গত, তার মাইনেপত্তর ভালো, এত দিন তার জবসন্তুষ্টিও ছিল। যত গোল বাঁধালো এই বিয়েটা।

অর্থাৎ রহমান তার মনমতো কাজ পেলেন, ভালো বেতন পান, বস তার কাজে সাতিশয় সন্তুষ্ট। কিন্তু প্রবলেম হলো এই, নিজের জন্য তার আর কোনো সময় নেই। তিনি বেশি রাতে বাসায় ফিরে সাতসকালে কাজে বেরিয়ে যান। এই নিয়ে নিত্য বউয়ের সঙ্গে তার বচসা হচ্ছে, ফলে তিনি মোটে মানসিক সুখ খুঁজে পান না, সারাক্ষণ বরং টানাপোড়েনের মধ্যেই থাকেন। একে আপনি ক্যারিয়ার সাকসেস বলবেন?  

কেস স্টাডি-২ 

নুরউদ্দিন ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন, মাইনে মোটামুটি, বেশ চলে যায়। তার যোগ্যতাও মাঝারি মাপের, তিনি এতেই খুশি। তার স্বপ্ন কম, এখানেই থিতু হতে চান নুরউদ্দিন। সব ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু করোনাভাইরাস এসে তার সব হিসাব গুবলেট করে দিলো। নুরউদ্দিন বিপাকে পড়লেন। কীরকম শুনবেন! 

যেহেতু করোনার কারণে কোম্পানির আয় কমেছে, নতুন ক্লায়েন্ট আনা যাচ্ছে না, মালিক ঠিক করলেন ছাঁটাই দিতে হবে, একেবারে গোড়া থেকে। নুরুউদ্দিনের চাকরি যায় যায়! অথচ তার পাঁচ সদস্যের সংসার। ছেলেরা পড়াশুনো করে। চাকরি গেলে খাবেন কী!  

অতি কষ্টে তার চাকরিটা বাঁচলো ঠিকই, কিন্তু তাকে এখন তিনজনের কাজ একাই করতে হয়। চাকরি বাঁচাতে। তারপরও বসের বকুনি, বাসায় ফিরতে অনেক রাত। ফলে ছেলেদের সঙ্গে তার দেখা হয় কম। তিনি প্রচণ্ড মনোকষ্টে আছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরিটা ছেড়ে দেবেন নুরউদ্দিন। 

কেস স্টাডি-৩

এশা স্মার্ট, মেধাবী ও চৌকস। মাস্টার্স শেষ করে তিনি একটি মারচেন্ট অফিসে চাকরি নিলেন। বায়িং হাউস টাইপ। সেখানে কাজের কোনো শিডিউল নেই, অন-লাইন অফ-লাইন দুই মাধ্যমেই কাজ হয়, বিদেশি বায়ারদের সাথে যোগাযোগ, তারা ফ্যাক্টরি ভিজিট করতে এলে তাদের সঙ্গ দেওয়া, স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পণ্য প্রস্তুত করতে পারবে বলে তাকে আশ্বস্ত করা-ইত্যাদি সব কাজ তাকে দেখতে হয়। নাম কা ওয়াস্তে হাউসের মালিক তাকে খুব একটা জ্বালাতন করেন না বটে, তবে এখানে সুস্থির নেই এশা। কাজটা কেন যেন তার ভালো লাগছে না। কাজের স্বাধীনতা থাকলেও তার নিজের জন্য মোটেও সময় নেই। ভারি ব্যস্ত থাকেন এশা। 

বেতন মোটামুটি, তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন বিধায় টাকার টানাটানি হয় না। তবে তার রাত করে বাসায় ফেরা নিয়ে মা খুব খিটিমিটি করেন। তার খুব দুশ্চিন্তা হয়, শহরটা তো খুব একটা নিরাপদ নয়। যদিও কোম্পানির গাড়ি তাকে ড্রপ করে, তারপরও এশার চাকরিটা ভালো লাগে না। এখানে স্বপ্ন দেখা বা মেধা ব্যবহারের সুযোগ কম। তাই জবসন্তুষ্টি নেই।

কেস স্টাডি-৪

হারুন সাহেব এককালে পত্রিকার রিপোর্টার ছিলেন। কোনো কারণে পত্রিকাটা উঠে যায়, তাই এখন তিনি একটা গবেষণা সংস্থায় চাকরি করছেন। কিন্তু শুরু থেকেই কাজে মন বসাতে পারছেন না হারুন, কারণ তিনি ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহে অভ্যস্ত, ডেস্কওয়ার্ক তাকে মোটেও স্বস্তি দেয় না। তিনি উসখুস করেন। সবচে বড় সমস্যা, বেতনও খুব একটা লিউক্রেটিভ নয়, অন টপ অব দ্যাট- যিনি তার বস তিনি খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বয়স্ক ভদ্রলোক, কিন্তু তার মাত্রাজ্ঞান কম। মাঝে মাঝে তিনি হারুনকে কফিও বানিয়ে দিতে বলেন। হারুন ভাবছেন চাকরিটা আর করবেন না। নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স- তিনি কিনা কারো জন্য চা বা কফি বানাবেন! কাজে তার মন ওঠে যায়, তিনি মনোকষ্টে ভুগতে থাকেন।

কেস স্টাডি-৫

রায়না স্বাধীনচেতা মেয়ে। তার বাপ বড়লোক, শিল্পপতি। কিন্তু তাও সে কিছু একটা করতে চায়, করে দেখাতে চায়। রায়নার বয়স কম, তাই তার স্বপ্ন বেশি। একবুক স্বপ্ন নিয়ে রায়না একটা করপোরেট ফার্মে ঢোকে। প্রথম প্রথম ভালো লাগলোও এখন যেন এখানে সে ঠিক অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না। কারণ বহুবিধ- প্রথম কারণ এই যে সে বড়লোকের মেয়ে, এত দিন সে অন্যকে কেবল আদেশ দিয়ে এসেছে, কারো কথা বা পরামর্শ তাকে শুনতে হয়নি। চাকরি কী জিনিস সে জানতো না। 

তাছাড়া কলিগরা তার প্রতি মোটেও বন্ধুভাবাপন্ন নয়, তারা রায়নার কেতাদুরস্ততাকে প্রশংসা করবার বদলে এই নিয়ে হাসাহাসি করে। যদিও সমস্যা রায়নার নয়, কিন্তু সবাই তো আর উচ্চ মন-মানসিকতার হয় না। রায়না মূলত পরিস্থিতির শিকার। তাছাড়া তার ইমিডিয়েট বসের টুকটাক অরুচিকর ইশারা-ইঙ্গিত তাকে আহত করে। বসের রুচি নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ পোষণ করে রায়না। ফলে এই অফিসে কাজ করা তার জন্য রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়ে। তার জবসন্তুষ্টি নেই।

কেস স্টাডি-৬

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে একটা সরকারি চাকরি পেলেন উদয়। বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার জব, আমি যার ঘোর বিরোধী। কারণ এতে মেধার অবমাননা করা হয়, যোগ্যতার ভারী অপমান। উদয় চাকরি পেলেন, কিন্তু কারো মন পেলেন না। ঢুকেই বুঝলেন এটা একটা ভিন্নতর জগত। বিউরোক্র্যাসি শব্দটা এতদিন শুনে এসেছেন, এবার তিনি হাড়ে হাড়ে তার মর্মার্থ টের পেলেন।

সিনিয়র অনেকেই তার মতো চৌকস নন, প্রযুক্তি বোঝেন না। যুক্তির বদলে জোরের যুক্তি চাপিয়ে উদয়কে থামিয়ে দিতে চান। বলেন যে, উদয় জুনিয়র, তাই মুখে মুখে কথা বলা চলবে না, বস ইজ অলওয়েজ রাইট। এমন কি, উদয় যা মানতে পারেন না, বা বে-আইনি মনে করে তাও তাকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া হয়। সোজা কথায়, অন্ধের কাছে তাকে দৃশ্যমানতা শিখতে হয়। তদুপরি, কথায় কথায় এসিআরে বাঁশ দেওয়ার ভয় দেখান, ইত্যাদি। 

সরকারি চাকরির নিশ্চয়তাটুকু বাদ দিলে আর কোনোভাবেই উদয় এখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। সে বুঝতে পারে যে, তার মেধা ও মননের প্রতি অবিচার করছে অফিস। ফলে প্রতিদিন সে একরকম ভয় বা সন্ত্রস্ত ভাব নিয়ে অফিসে আসে ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাসায় ফেরে। এভাবে কি চাকরি করা যায়! সংক্ষেপে বললাম, বাকিটা নিজ উদ্যোগে বুঝে নেবেন আশা করি।

কথা আর না বাড়াই। ছোটো ছোটো কিছু দৃশ্যপট থেকে আমি এটাই বোঝাতে চাইছি যে, থিওরি দিয়ে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বা ক্যারিয়ার সাকসেস ব্যাখা করা গেলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ একেবারেই সহজ নয়। খুব কম ক্ষেত্রেই চাকরিটাকে উপভোগ করা যায়, মনমতো চাকরি মেলে। ফলে এটা গ্রাসাচ্ছাদনের নিমিত্তে করা হয় বলে জাস্ট মেনে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। তবে ক্যারিয়ার বিষয়ে আমার ছোট্ট উপলব্ধি এই, যে কাজে আনন্দ নেই, তা অতি অবশ্যই বর্জনীয়।

নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মানী না পেলে আত্মসম্মান নষ্ট হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! সবচেয়ে বড় কথা, জীবনের জন্য কাজ, জীবিকার জন্য জীবন নয়। এটুকু মাথায় রেখে চাকরি করতে পারলে ভালো। সবার আগে পরিবার, তারপর অন্যসব। অবশ্য মন চাইলেই হবে না, জব মার্কেটের কথাও ভাবতে হবে। অনেক সময় অনেক যোগ্য লোকও ভালো চাকরি পান না। কারণ তিনি হয়তো সঠিক দরজায় কড়াঘাত করতে ভুল করেছেন। বা তার পক্ষে সমঝদার ও শক্তিধর ‘লবিস্ট’ নিয়োগ করা হয়নি। 

বস্তুত, কাজের ধরন, কর্মপরিবেশ, যোগ্যতানুযায়ী বেতন ও পদায়ন এবং কাজের সময়- এসব বিষয় ঠিকঠাক মিলে গেলেই তাকে মোটামুটি ‘সাকসেসফুল ক্যারিয়ার’ বলে ধরে নেওয়া যায়। স্বপ্ন-টপ্ন, ওসব থিওরি বা বইয়ের পাতায় বেশি দেখা যায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ রাজস্ব বোর্ড।

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়