স্মৃতিজুড়ে স্কুলজীবন
আয়েশা আক্তার || রাইজিংবিডি.কম
‘মসজিদ মিশন একাডেমি’ আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম হাতেখড়ি। স্কুলটি রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এখানে আমি দীর্ঘ ১২ বছর আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করেছি।
স্কুল থেকে সামান্য দূরেই পদ্মা নদী। যখন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো, তখন ঠিক নদীর ধারেই এক বিশাল মাঠ ছিল, সেখানে খেলাধুলা হতো। স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া থেকে এসএসসি পাস করে বের হওয়া দুটোই ছিল মজার ঘটনা। এত বছরের অতিবাহিত স্কুলজীবন থেকে মজার কয়েকটি ঘটনা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছি, যা সবসময় আমার স্মৃতিপাতা থেকে উঁকি দেয়।
আমি এত ছোট বয়সে স্কুলে ভর্তি হই যে, শিশু শ্রেণির কথা এখন তেমন মনেই পড়ে না। মায়ের মুখে শুনেছি, ভর্তির সময় নাকি স্কুল গেটে অনেক ভিড় থাকায় আমার বাবা সেটা কমানোর কথা বলেছিলেন, তাতেই টিচারদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়। অবশ্য শুনেছি, শেষে প্রিন্সিপাল স্যার বাবার কাছে নিজ হাতে ক্ষমা চান আর কোনো পরীক্ষা ছাড়াই আমাদের দুই বোনকে ভর্তি নেন।
আমার ছোটবোন বেশ চঞ্চল ছিল। প্রায় সে যে কাজ করতো, সেটা হলো টয়লেট থেকে বের হয়ে সোজা প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে গিয়ে স্যারকে বলতো, ‘আমার সালোয়ারের ফিতাটা বেঁধে দিন তো, স্যার।’ স্যারও হাসি দিয়ে যত্নসহকারে ফিতা বেঁধে দিতেন।
আমার শিক্ষাজীবনে অনেক বান্ধবী হয়েছে। কিন্তু স্কুলে ২/৩ বছরের জন্য এমন এক বান্ধবীকে পেয়েছিলাম, যাকে এখনো খুঁজে বেড়াই। নাম উম্মে আয়েশা হিমিকা। কোনো কারণে আমি কাঁদলে কারণ না জেনেই সেও কাঁদতে শুরু করতো। আমাকে না দিয়ে সে টিফিন খেতো না। আমি স্কুলে না গেলে তার পাশে কাউকে বসতে দিতো না!
একবার ক্লাস ফোরে টিফিন খেতে গিয়ে এক ক্লাসমেটের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে আমার থুতনি কেটে অনেক রক্ত পড়ে। পুরো স্কার্ফ রক্তে ভিজে যায় কিন্তু যখন টিচাররা এসে জিজ্ঞেস করছিল, কীভাবে হয়েছে? বান্ধবীকে বাঁচানোর জন্য বলেছিলাম, নিজে থেকে পড়ে গিয়ে হয়েছে।
আমার স্কুলের সব শিক্ষককেই আমার ভালো লাগতো। শুধু ধর্ম স্যার বাদে। পড়া না পারলে উনি অনেক মারতেন। আর বাসা থেকে হয়তো দেরি করে বের হতেন, তাই লুঙ্গিটা লেংটি দিয়ে উপরে পাজামা পড়তেন।
হাসিনা ম্যাম আমার আদর্শ। একজন দুর্বল শিক্ষার্থীকে কীভাবে পাঠে মনোযোগী করা যায়, আমার মনে হয় তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আমাদের সমাজ বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই যদি আমার সাবজেক্টে সর্বোচ্চ পাস, আমি সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াবো।’ সত্যি আমি উনার বিষয়ে সর্বোচ্চ মার্কস (৮৮) পাই, আর ম্যাম ক্লাসের সবাইকে আইসক্রিম খাওয়ান ও ক্লাস অফ দেন। অন্য ক্লাসের টিচাররা ও শিক্ষার্থীরা দেখতে এসেছিল। এতে আমি ম্যামের সামনে কাঁদতে শুরু করেছিলাম।
একবার ক্লাস নাইনে ভীষণ অসুস্থ থাকায় বেশ কিছু দিন স্কুলে যাইনি। কিন্তু যেদিন গেলাম, দেখি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ফাইনাল ডে। হাসিনা ম্যাম সবাইকে উপেক্ষা করে ফাইনাল প্রতিযোগীদের সঙ্গে আমার নাম দেন ‘চেয়ার বসা’ খেলায়। আর বলেন, ‘অবশ্যই ফার্স্ট হবি আর প্রাইজটা আমাকে দিবি।’ আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম। প্রাইজটা ম্যামকে দিতে গেলে বলেন, ‘তোর শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে এই প্লেটে খাবো।’
আজ আমার হাসিনা ম্যাম বেঁচে নেই। আমার এক বান্ধবী পড়াশোনা শেষে এই স্কুলেই চাকরি করে। তো সে বললো, গত বছর ম্যাম বলেছিলেন, ‘আয়েশা আসলে স্কুলে আসতে বলিস, আর একটু কথা বলিয়ে দিস।’ ঠিক তার ৩/৪ মাস পর চরম অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। আজ আমি নিজেও একজন স্কুলশিক্ষক আর হাসিনা ম্যাম আমার অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়।
এখন আমার স্কুলের তিনটা শাখা হয়েছে। আগের চেয়েও অনেক নামডাক হয়েছে। এখনও রাজশাহীতে গেলে স্কুলের ভ্যানচাচা বা টিচারদের সঙ্গে দেখা হয়। বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ তো আছেই। স্কুলজীবনের দুষ্টুমির মিষ্টি স্মৃতি সত্যি ভোলার নয়।
লেখক: শিক্ষক, হাবিব নগর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়।
রাজশাহী/তৈয়ব/মাহি
আরো পড়ুন