ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘৪৯ বছরেও বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ পাইনি’ 

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ৩ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:২৪, ৩ ডিসেম্বর ২০২০
‘৪৯ বছরেও বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ পাইনি’ 

ডিসেম্বর, অহংকার আর গৌরবের মাস; আমাদের বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই সূচনা হয় বাঙালির নবজীবনের। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাভূত হয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। আমরা পেয়েছি এই লাল সবুজের পতাকা। এই দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ। 

বিশ্বের বুকে আবির্ভূত হয় একটি জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই বাংলাদেশের আছে নানা অর্জন, আছে নানা চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল দেশের তরুণ সমাজ। বিজয়ের মাসে কী ভাবছেন তরুণরা? কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণের ভাবনা নিয়ে লিখেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।

আমজাদ হোসেন হৃদয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিজয়ের ৪৯ বছর পরও আমরা পরিপূর্ণ সুফল পাচ্ছি না। আমাদের এই বিজয় কেবল একটি জাতীয় পতাকা বা স্বাধীন একটি ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং বৈষম্যহীন দেশ গঠনের প্রেরণা এই বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। সুদীর্ঘ ৪৯ বছর একটি জাতির জন্য কম সময় নয়, কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়ে দেশের মানুষ যে জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, সেই বাক স্বাধীনতা, সেই ভোটাধিকার, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, জন নিরাপত্তা আজও সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের শাসকরা এখনো পর্যন্ত জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। ব্যক্তি স্বার্থ ও দলীয় মতের উর্ধ্বে ওঠে দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করা নেতার শাসন এখনো অধরাই রয়ে গেলো। 

ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্রসংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্য ও প্রশ্ন ফাঁস শিক্ষা খাতে কাঙ্ক্ষিত অর্জনকে বাঁধাগ্রস্ত করছে। দেশজুড়ে মাদকের ছড়াছড়ি তরুণ সমাজকে অন্ধকার জগতে ঠেলে দিচ্ছে। সর্বোপরি স্বাধীনতার সম্পূর্ণ সুফল পেতে আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হতে হবে।

মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে বলেই বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মর্মকথা হলো গণতন্ত্র, যে গণতন্ত্রে আছে ন্যায়পরায়নতা, নাগরিকদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অধিকারের সমতা, পরমতসহিষ্ণুতা। আজ আমাদের রাজনীতি এসব নীতি থেকে অনেক দূরে। আমাদের গণতন্ত্র অনিশ্চিত ও ভঙ্গুর। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ। এমনকি, একটি সরকারের মেয়াদ শেষে জনগণের মুক্ত-স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে সৎ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক ও স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও এখনো গড়ে তোলা যায়নি। 

আমাদের বিজয় সেদিনই সফল হবে, যেদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা বাংলার ১৬ কোটি মানুষের মুখে হাসি ফুটাবে। সেদিন থাকবে না কোনো দুর্নীতি, থাকবে না কোনো অনাহারী, থাকবে না অশিক্ষিত মানুষ। পৃথিবীর মানচিত্রে লাল সবুজের বাংলাদেশ হবে নবজাগরণে উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ।

আব্দুস সবুর লোটাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বিজয় শব্দটা শুনলেই আনন্দ লাগে ভেতরে। যেকোনো বিজয়ই সাধারণভাবে আনন্দের হয়, তবে বিজয়ের পেছনে থাকে বৃহত সংগ্রামের ইতিহাস৷ ডিসেম্বর আসলেই বিজয় দিবসের আনন্দের বাতাস বয় ভেতরে। এই আনন্দের জন্য প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবন দিতে হয়েছে। এর মধ্যে অনেক শিশু আছে৷ অনেকে তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। ফলে আমরা পেয়েছি এই সবুজ-শ্যামল ভূখণ্ড। এই বিজয়ের জন্য যারা জিবন দিয়েছেন, সবাই পাকিস্তানের অন্যায়, অত্যাচার, দুশাসন থেকে মুক্তির জন্য জিবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ, ক্ষুধা ও বৈষম্যহীন একটি সুন্দর দেশের। তাদের আকাঙ্ক্ষা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। 

আমরা সেই বীরদের আত্মত্যাগের কথা কোনো দিন ভুলবো না। গভীর শ্রদ্ধায় আমরা তাদের স্মরণ করবো। আমরা যেন তাদের আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ সম্মান করতে পারি সারাজীবন। সেই সঙ্গে দ্রুতই মুক্তিযুদ্ধাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হোক, এ দেশে এটাই চাই।

অনন্য প্রতীক রাউত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিজয় মানে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের জীবনাবসান, ২ লাখ ৭৬ হাজার মা-বোনের ইজ্জতের সংমিশ্রণ আমাদের বিজয়। যেই পথ পরিক্রমায় সামনের সারিতে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তরুণদের। জীবনের বিশাল সময় রয়েছে পড়ে, সোনালী ভবিষ্যৎতের আছে হাতছানি, তাও দমে যাননি তরুণেরা। অন্যায়, অবিচার তথা পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন অবিরাম। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন জনতার সঙ্গে, গড়ে তুলেছে ‘মুজিব বাহিনী’। ধ্বংস করেছেন হানাদার বাহিনীর একের পর এক পরিকল্পনা। 

কষ্টার্জিত এই বিজয় তাই আমাদের অস্তিত্ব, এগিয়ে যাবার প্রেরণা। কোনোভাবেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই মহান মুক্তিযুদ্ধের। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক সেই চেতনা, এটাই চির প্রত্যাশা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের করা হোক অপসারণ, অপশক্তিকে করা হোক পদানত, সৃষ্টি হোক ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর বাংলাদেশ। এগিয়ে যাক প্রিয় মাতৃভূমি।
তাহমীদ হাসান শোভন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিজয়ের ৪৯ বছরে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ বিজয়ের স্বাদ পেয়েছে। সেই থেকেই বাঙালি পেয়েছে রাষ্ট্রের ৪টি উপাদানের অন্যতম একটি প্রধান উপাদান নির্দিষ্টি ভূখণ্ড। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিজয়ের ৪৯ বছরেও বাংলাদেশ বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ পায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যেন বাঙালির বিজয়ের নিশানটিও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বিভিন্ন দল একাধিকবার ক্ষমতায় আসলেও জনগণের মনের মতো করে দেশকে এগিয়ে নিতে পারেনি। তারা পারেনি অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোকে পূরণ করতে। বরং দলগুলোর পাল্টাপাল্টি রেশারেশিতে প্রাণ হারিয়েছে হাজারো সাধারণ জনতা। 

বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছর পূরণের ক্রান্তিলগ্নে এসেও দেশকে সাক্ষী হতে হচ্ছে হত্যা, ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনার। তাই সহজেই অনুমেয় বিজয়ের স্বাদ বাংলাদেশ পুরোটা পেতে এখনো ব্যর্থ।

হিরা সুলতানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইতিহাসের শত বছরের শোষিত জাতির নাম বাঙালি জাতি৷ যুগে যুগে নানা শাসকগোষ্ঠী দ্বারা শোষণের পর অবশেষে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো সোনার বাংলা গড়তে অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে দেশের মানুষ এগিয়ে যাওয়ার প্রহর গুণতে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দূর্নীতিসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আমরা এখনও দেখতে পাইনি। দেশের এমন কোনো খাত নেই, যেখানে দুর্নীতির থাবা লাগেনি। যেদিকে তাকাই শুধু ঘুষ, দুর্নীতি, দুর্ঘটনাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশ। এ সংকটকে সম্ভাবনায় তৈরি করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব। 

তরুণরাই পারে এ দেশের হাল ধরতে। দেশে সুশাসন, নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য সুষ্ঠভাবে পালন, গুণগত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া ও তরুণ প্রজন্মকে শক্তিতে রূপান্তর করার মাধ্যমে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব৷ আর এতেই সার্থকতা লাভ করবে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত। সার্থকতা লাভ করবে স্বাধীনতা। অন্যথায় এ বিজয় অর্থহীন।

সোহানুর রহমান সোহান, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্রখচিত বাংলাদেশে উদযাপিত হবে বিজয়ের ৪৯ বছর। অর্ধশতক ছুঁতে মাত্র আর একটি বছর বাকি, বাংলাদেশি হিসেবে এ বিজয়োল্লাস আমাদের বাঁধভাঙা। বিজয়ের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে আমাদের যেমন অসীম ঘাটতি, অসামঞ্জস্যতা, আর অক্ষমতার দেখা মেলে, ঠিক তেমনিভাবেই কতগুলো প্রাপ্তি আর শক্তির জায়গাও তৈরি হয়েছে ইতোমধ্যেই। সময়ের প্রয়োজনেই হোক কিংবা আদর্শিক জায়গা থেকেই হোক আমরা একটি বিজয় পেয়েছি এটি পরম গৌরবের। বিজয়ের সমুন্নতায় সামগ্রিকভাবে আমাদের আরো অনেক বেশি তৎপরতা প্রয়োজন। কালে কালে প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের চাহিদার পরিবর্তন ঘটে। 

বর্তমান প্রেক্ষাপটের সবচেয়ে বড় চাহিদার জায়গা তৈরি হয়েছে আমাদের দেশের দুর্নীতির নির্মূলকরণ। প্রত্যেক সাংসদ, মন্ত্রী, আমলার উপর বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে তাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি এনে দুর্নীতি দমন ও তাদের কর্মোদ্দীপনা বাড়ানোর জন্য বিশেষায়িত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সমকালীন চাহিদা। মোদ্দাকথা, রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিত হবে অগ্রসর বিষয়গুলোকে যথাযথ গতিতে রেখে অসামঞ্জস্যতার দিকগুলোতে কঠোর নজরদারি করে আমাদের অর্জিত বিজয়কে সমুন্নত রাখা।

নিপা রানী সাহা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তে রাঙিয়ে রাতের অন্ধকার ভেদ করে বাংলার দামাল ছেলেরা কেড়ে এনেছিল ফুটন্ত সকাল। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় মাস এটি। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার মাস। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে অব্যাহত আছে বাঙালির এগিয়ে যাওয়া। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে হয়তো এতটা আয়োজন সম্ভব হবে না, তবুও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি আজীবন স্মরণ করিয়ে দেবে আমাদের মাঝে জাগ্রত করবে বিজয়ের চেতনা। 

বিজয়ের এই অর্ধশত বছরের প্রাক্কালে চলুন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই আমরা, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরো বেশি অবদান রাখি। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিই সমৃদ্ধ আগামীর পথে।

জবি/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়