ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের ভাবনায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ 

কুলসুম আক্তার স্মৃতি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৮, ১৯ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৮:৫১, ১৯ জানুয়ারি ২০২১
মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের ভাবনায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ 

বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্য দিয়ে এক কঠিন সময় অতিবাহিত করছে গোটাবিশ্ব। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। দেশে করোনার প্রথম ওয়েবের তাণ্ডব শেষ হতে না হতেই, করোনার দ্বিতীয় ওয়েবের তাণ্ডবে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ জীবনযাপন। আসন্ন শীত করোনা সংক্রমণের হার অতিমাত্রায় ত্বরান্বিত করছে। বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন দর্শন। করোনার দ্বিতীয় ওয়েব নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের (এমবিবিএস ১ম বর্ষ) শিক্ষার্থীদের ভাবনা তুলে ধরছেন একই মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী কুলসুম আক্তার স্মৃতি। 

হাসান মাহমুদ শুভ, এমবিবিএস (১ম বর্ষ)

সারাবিশ্ব ভয়াবহ কোভিড-১৯ কারণে বিপর্যস্ত, অচলাবস্থা, আমরাও সেই বিপর্যয়ের অংশীদার। মানুষ স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন। অন্য সব মহামারি থেকে কোভিড-১৯ ব্যতিক্রম। অন্য সব ভাইরাসের চরিত্র ও গতিপ্রকৃতি বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করতে পারলেও কোভিড-১৯-এর প্রকৃত গতিপথ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তাই এমন পরিস্থিতিতে এর মোকাবিলায় মাস্কের ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মনে চলার বিকল্প নেই। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড -১৯-এর প্রথম ওয়েব পেরিয়ে দ্বিতীয় ওয়েবের তাণ্ডব চলছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। গত ২/৩ মাস আগে এর সংক্রমণের হার নিম্নমুখী থাকলেও আসন্ন শীতে সংক্রমণের হার অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা দিয়েছে উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক ও দুঃস্বপ্নের হাতছানি। 

দ্বিতীয় ওয়েব মোকাবিলায় সরকার ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। মাস্ক ছাড়া কাউকে সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা দেওয়া নিষিদ্ধ হলেও তা যেন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। নেই কোনো ফলশ্রুত প্রতিফলন। আমরা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ঘোরাঘুরিসহ নানা উৎসবে মেতে উঠেছি, যা মোটেই কাম্য নয়। আসুন আমরা যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। পাশাপাশি ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি বাস্তবায়নে সাহায্য করি। তাহলে কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ওয়েব অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে।

ফয়সাল হোসেন, এমবিবিএস (১ম বর্ষ)

আপনি করোনায় আক্রান্ত কিনা কীভাবে বুঝবেন?
শুকনো গলা, শুকনো কাশি, উচ্চ তাপমাত্রা, শ্বাসকষ্ট, গন্ধ ও স্বাদ না পাওয়া।

সাধারণ লক্ষণ-

সংক্রমণের তৃতীয় দিন থেকেই লক্ষণগুলো দেখা দেয়।

প্রথম স্তর-

শরীর, চোখ বা মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, ডায়েরিয়া, অনুনাসিক প্রবাহ, জ্বর অনুভূতি।

করণীয়-

লক্ষণের দিন গণনা করা গুরুত্বপূর্ণ। জ্বর শুরুর আগে থেকেই প্রচুর তরল, বিশেষত বিশুদ্ধ পানি পান করুন। এটি গলা আর্দ্র রাখে, ফুসফুস পরিষ্কার করে।

দ্বিতীয় স্তর (চতুর্থ-অষ্টম দিন) প্রদাহজনক।

স্বাদ বা গন্ধ ক্ষতি, ক্লান্তি, বুকের ব্যথা, কিডনি অঞ্চলে ব্যথা। সর্বশেষে স্নায়ু আক্রমণ। এসময় প্রচুর পানি ও ভিটামিন-সি প্রয়োজন।

তৃতীয় স্তর-নিরাময়

৯ম থেকে ১৪ দিন অবধি চলতে পারে। চিকিৎসা বিলম্ব করবেন না।

প্রতিদিন ১৫-২০মিনিট রোদে বসুন, বিশ্রাম নিন, কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান, দেড় লিটার পানি পান করুন, গরম খাবার খান। সর্বোপরি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। নিজে সুস্থ থাকুন, অন্যকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করুন।

ফাইয়িক ইবতিদা, এমবিবিএস (১ম বর্ষ)

কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে দেখা গেছে, গুরুতর কোভিড রোগীদের মধ্যে ১২-২২ শতাংশ এবং ২৩-৩০ শতাংশ রোগীদের যথাক্রমে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ ছিল। অন্য প্রতিবেদনে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস গুরুতর কোভিড-১৯-এর উচ্চ ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে পরামর্শ দেয়। 

হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস এবং এসএআরএস-কোভিড-২ এর মধ্যে লিঙ্কটি অ্যাজিওটেনসিন-রূপান্তরকারী এনজাইম২ (এসিই-২)।  এসিই-২, ফুসফুস, অন্ত্র, কিডনি এবং রক্তনালী এপিথেলিয়াল কোষগুলোতে প্রকাশিত কোষগুলোকে সংক্রামিত করার জন্য অন্যতম ব্যবহৃত রি-রিসেপ্টর সারস-কোভিড-২, যার কারনে যারা হৃদরোগ, ডায়বেটিস কিংবা উচ্চ রক্তচাপ এমনি হাপানিসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত, তাদের অনেক নিয়ম মেনে চলা উচিত। যার মধ্যে অন্যতম হলো- জ্বর কিংবা হাঁচি-কাশি হলে নিজেকে আলাদা করে নেওয়া, ইনসুলিন ঠিক মতো নেওয়া, ইনহেলার সবসময় কাছে রাখা, বাইরে হাঁটতে না যাওয়া, শর্করা কম খাওয়া, পানি কুসুম গরম করে খাওয়া, স্টিম নেওয়া ইত্যাদির পাশাপাশি আসন্ন শীতে শিশু ও বৃদ্ধদের বাড়তি সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। 

কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যে কারণে অল্পতেই করোনা বা ঠান্ডাজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। সর্বোপরি, সবসময় সর্বোচ্চ সতর্কতা ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। 

আফ্রিদী রহমান, এমবিবিএস (১ম বর্ষ)

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধের সময়সীমা দফায়-দফায় বাড়ানো হয়। শিক্ষার্থীদের সেশনজট থেকে রক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষাকার্যক্রমের ছন্দ ধরে রাখতে সরকার অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা কে ঘিরে আছে নানা আলোচনা এবং সমালোচনা। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নেই পর্যন্ত ইন্টারনেট সুবিধা। গ্রাম থেকে উঠে আসা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের পক্ষে চড়া মূল্যে ডাটা, স্মার্ট ফোন কিনে ক্লাস করা অসম্ভব প্রায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম থেকে ছিটকে পড়ছে। অপর দিকে শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে একধাপ এগিয়ে রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম শহরের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রাপ্তির জায়গায় হলেও গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেই প্রাপ্তির নয়। তবুও অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ছন্দ ধরে রাখাসহ শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে দূরত্বটা কমিয়ে এনেছেন। 

রাহুল দত্ত, এমবিবিএস (১ম বর্ষ)

করোনাকালে গৃহবন্দি জীবন, বেকারত্ব, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতা, সংক্রমণভীতি, করোনার সেকেন্ড ওয়েব নিয়ে দুশ্চিন্তা। এসব আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। 

WHO এর  রিপোর্ট (জুন-আগস্ট-২০) অনুযায়ী বিশ্বের ১৩০টি (৯৩ শতাংশ) দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরিপে দেখা গেছে ৭০ শতাংশ কিশোর, ৭২ শতাংশ বয়স্ক ব্যক্তি ও ৬১ শতাংশ মহিলা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘন ঘন নিশ্বাস নেওয়া, শরীর কাঁপা, ঘাম দেওয়া, মাথা ঘোরা, ডায়েরিয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে সচেতনতা ও মানসিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। সুস্থ্য অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বই পড়া, সবার সঙ্গে ভাববিনিময়, পরিবারকে সময় দেওয়া, প্রতিদিন মেডিটেশন করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। 

হোসনে আরা ইয়াসমিন, এমবিবিএস (১ম বর্ষ)

বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা নির্বাহ অত্যাবশ্যক। বিভিন্ন পেশার মানুষ বিভিন্নভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু তাদের এই জীবিকা নির্বাহের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা পরিস্থিতি।

চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে দেশে দফায়-দফায় লকডাউনের কারণে ৩৬ শতাংশ মানুষ চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছে। বেড়েছে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সংখ্যা। অপর দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন। অনাহারে অর্ধাহারে কাটছে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে সামাজিক দূরত্ব মেনে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যারা দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন তাদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে বেকারত্বের সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তার কোন সন্দেহ নেই।  সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধির কথা মাথায় রেখে দেশের কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুললেই তা বেকারত্বের হারে পর্যপ্ত নয়।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও সমাজের বিত্তশালীদের মানবিকতার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

গাজীপুর/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়