ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমার চোখে ঢাবির শতবর্ষ   

সানজানা হোসেন অন্তরা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৫, ২৭ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৪:৩৭, ২৭ জানুয়ারি ২০২১
আমার চোখে ঢাবির শতবর্ষ   

আপনি কি জানেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কীভাবে আলাদা? পৃথিবীর প্রতিটি দেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দেয়, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা দেশের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পেরে নিজেকে সত্যি অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি। 

ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্নের বাস্তব রূপ পাওয়াটা আমার মতো প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনে চরম আনন্দের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান একটা দেশের জন্ম দিয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এ বিজয় অর্জন পর্যন্ত সমস্ত আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়িত ছিল। ১৯২১ এ প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ পূরণ হবে চলতি বছর ২০২১-এ। শতবর্ষে এসে প্রাণের ক্যাম্পাসকে দেখতে চাই আরো নতুনত্ব ও সৌন্দর্যমন্ডিত রূপে। 

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সুখ্যাতি এদেশে, প্রায় সবদিক থেকে এগিয়ে দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ করার অবকাশ নেই। তবে আমার সামান্য জ্ঞানে আমার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকট সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম বর্ষ ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের চরম অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকে বলে থাকেন গরিবের বিশ্ববিদ্যালয়, শুনতে অন্যরকম লাগলেও এটাই সত্যি। কথাটি আমি প্রথম শুনেছি একজন শিক্ষকের কাছে, তিনি প্রচণ্ড গর্ব করেই বলেছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  গরিবের বিশ্ববিদ্যালয়, পয়সার জোর যেখানে খাটে না, শুধু মেধার জোরেই একজন শিক্ষার্থী পায় ঢাবিয়ান পরিচয়’। 

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আসেন গ্রাম থেকে, এদের অনেকের পরিবারই অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে। এই মেধাবী অথচ দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে এসে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার পরও চরম আবাসিক সংকটে পড়ে, তখন তা সত্যি চরম হতাশার বিষয়। এর অন্যতম কারণ হলো নতুন করে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও প্রশাসন থেকে নতুন হল তৈরি না করা, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গণরুমের মতো পরিবেশ তৈরি করে শিক্ষার্থীদের থাকতে হচ্ছে। কারণ, ঢাকা শহরে অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা-খাওয়া বহন এসব মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে অনেক বড় বোঝা, আর যেখানে মেধার জোরে জায়গা করে নেওয়ার সাথে সাথে একটা হল তাকে আট্যাচ করে দিতে ১/২ বছর সময় লেগে যায়। তাই বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীরা গণরুম বা পলিটিক্যাল রুমে উঠতে বাধ্য হয়। 

হলগুলোর আবাসিক সংকটের আরেকটি কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী মাস্টার্স শেষের সাথে সাথেই সেই শিক্ষার্থীকে হল ত্যাগ করতে হবে, নতুনদের আবাসন সুযোগ করে দিয়ে কিন্তু বাস্তবিক অর্থে দেখা যায় পড়ালেখা শেষ করেও চাকরি প্রার্থীরা হলে জায়গা দখল করে থেকেই যায়। ফলে নতুনরা আবাসন সংকটে পড়ে। আমি নিজেও এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার মতো আরো অনেক শিক্ষার্থী বিশেষ  করে ছেলেদের হলে এই অবস্থা আরো বেশি, এমনও দেখা গিয়েছে হলের বারান্দায় তাদের থাকতে হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থী হিসেবে এটাই কাম্য হবে, আগামীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আবাসিক সংকট নিরসন হবে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হল ত্যাগের প্রতি কড়া নজরসহ আরো বেশি আবাসিক সুযোগ তৈরি করতে হবে এক শিক্ষার্থী এক আসন ভিত্তিতে। দরকার হলে হল সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। 

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বারান্দায় রাত কাটাবে, এক রুমে ২০/২৫ জন থাকবে বা হলে সিট না পেয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে বাধ্য হবে, এমন পরিস্থিতি যেন না হয়, তার যথাযথ ব্যবস্থা করবেন প্রশাসন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর চাওয়া। শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের চাওয়াটার বাস্তবরূপ পূরণের কাজ শুরু করবেন আশা করি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি সমস্যা হলো ঢাবির কেন্দ্রীয় পাঠাগারের জায়গার অভাব, শিক্ষার্থীরা চাইলেও সবাই সেখানে বসে পড়াশোনা করতে পারে না। অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা যারা চাকরির জন্য পড়ালেখা শুরু করছেন, তাদেরই বেশিরভাগ দেখা যায় লাইব্রেরিতে। সেই সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে তবেই তারা ঢুকতে পারে। আসন সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর ইচ্ছা থাকলেও পাঠাগারে বসে পড়ালেখার সুযোগ পায় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত পাঠাগার সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা। যে জাতি যত বেশি বই পড়ে, সে জাতি তত বেশি উন্নত। সেই পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করাও আবশ্যক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটা বড় দিক হলো রাজনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির সূতিকাগার অনেকে বলে থাকেন। হ্যাঁ তা সত্যি গর্বের বিষয়। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই আছেন যে, কেউ রাজনীতিতে যুক্ত শুনলেই ভ্রু কুচকায়। আচ্ছা রাজনীতি করা কি খারাপ? রাজনীতি অবশ্যই দরকার, রাজনীতিবিদদের দরকার, তবে অবশ্যই সুস্থ রাজনীতির চর্চা করতে হবে। জি ভাই জি ভাই নীতি পরিবর্তন করে নিজের বুদ্ধি বিবেক দিয়ে ভেবে সম্মতি দিতে হবে। ঢাবির শিক্ষার্থী যদি রাজনীতি না করেন, তাহলে করবে কে? দেশের যেকোনো স্থানে রাজনীতির ক্ষেত্রে অবশ্যই মেধার বিচার করতে হবে। সেই ব্যক্তি রাজনীতিবিদ, যিনি সত্যিকার অর্থে দেশকে নিয়ে ভাবেন, দেশের খবরাখবর রাখেন, যে নিজের মেধা, বুদ্ধি, বিবেক, আত্মসংযম দিয়ে সুস্থ রাজনীতির চর্চা করতে পারবেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ যেমন নিজেদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের কথা ভেবে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ঠিক একইভাবে সোনার বাংলা গড়ে তুলতেও দরকার মেধাবী রাজনীতিবিদদের। যাদের বন্ধুত্ব থাকবে বইয়ের সাথে, যারা জানবে বুঝবে সত্যিকার ইতিহাস, সভ্যতা, ত্যাগের কথা। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই তো তারা নিজেদের করবে সমৃদ্ধ, যাতে তারা দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আগের মতো সংঘবদ্ধতা নেই, রাজনীতি যেন এক চাপিয়ে দেওয়া বোঝা। একজন শিক্ষার্থী যে নিজেকে রাজনীতির মাঝে রাখতে চায় না, তাকেও অনেক সময় হলে থাকার কারণে যেতে হয়। এই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতি কখনো দেশের কল্যাণে আসবে না বরং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়।

যাদের সত্যিকার অর্থে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা, তারা যদি তাদের সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যায়, তবেই তা সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে। ঢাবির শতবর্ষে এসে আমাদের উচিত অসুস্থ জোরপূর্বক রাজনীতি বন্ধ করে, সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা, যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রাজনৈতিক পরিবেশ বাংলাদেশের সবার কাছে এক উজ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এত অসুবিধার পরে অনেকেই বলতে পারেন, তাহলে কি শুধু অসুবিধাই বিরাজ করছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে? না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং আগামীতেও আসবে। গঠন কাঠামোতে যেমন অনেক পরিবর্তন হয়ে উন্নত হয়েছে, পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর ও মধুর দিকটি হচ্ছে তাদের নিজেদের মধ্যেকার কমিউনিটি অনেক জোরালো। একে-অপরের পাশে থাকে। একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী যখন অনেক বড় কোনো পদে, তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ছোট-ভাইবোন সাহায্য চাইলে তিনি তার সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন সমস্যা সমাধানের। এমনও হাজার সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৈরি করছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সাহায্যের জন্য সম্প্রতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘নবযাত্রা’ টিম। পাশাপাশি আরো অনেক সংগঠন আছে, সাংস্কৃতিক থেকে শুরু করে নিজের দক্ষতা যেকোনো দিকে বৃদ্ধি করার জন্য এমন অনেক সংগঠন আছে, যা একজন শিক্ষার্থীকে বিকশিত করতে অনেক বেশি সাহায্য করে। 

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজনেস কমিউনিটি’, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সব উদ্যোক্তাকে এনেছে এক প্ল্যাটফর্মে। অনেক অনেক সুবিধার পরও যততুকু অসুবিধা আছে আশা করতেই পারি, আগামীতে এই সমস্যাগুলো আমরা সবাই মিলে কাটিয়ে উঠবো এবং আগামীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে আরো উন্নত। সার্থক হোক শতবর্ষ উদযাপন। 

লেখক: শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাবি/মাহি  

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়