ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জিনের মসজিদে এক দুপুর

শেখ নাসির উদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৩, ২৮ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৬:০৭, ২৮ জানুয়ারি ২০২১
জিনের মসজিদে এক দুপুর

করোনার ঘরিবন্দী ছিলাম বেশ কয়েক মাস। আমার সবসময় ঘুরতে খুব ভালো লাগে। নতুন বছরে কোনো দর্শনীয় স্থানে যাবো। ছবি তুলবো আর সে জায়গা নিয়ে লিখবো। এটাই হওয়ার কথা ছিল কিন্তু করোনা ঘরবন্দী করে রেখে দিয়েছিল। যাইহোক নতুন বছরের শুরুতে এবার ঘুরে এলাম উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও থেকে।

পৌষ মাসের কনকনে শীতে গরম কাপড় নিয়ে রাতে বেরিয়ে পড়লাম ঠাকুরগাঁওয়ের পথে। কুয়াশা ও তীব্র শীত দেখলাম ঠাকুরগাঁও শহরে নেমে। তারপর সেখানে নাস্তা করে আঞ্চলিক বাসে চেপে বসলাম। বাস আমায় নামিয়ে দিল সদর উপজেলার ভুল্লি বাজারে, সেখানে পৌঁছাতে সকাল ১১টা বেজে গেলো। এরপর খাবার খেয়ে অটোরিকশায় ছোট বালিয়া নামিয়ে দিলো। পাঁকা রাস্তা থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলাম। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি বিশাল আকারের লাল ইটের একটা মসজিদ। 

আমার মতো অনেকে এখানে এসেছেন মসজিদ দেখতে। পৌঁছাতেই জোহরের আজান হলো মসজিদের মাইকে। ওজু করে বিশাল কাঠের দরজা দিয়ে ভেতরে যেতেই আরো মুগ্ধ হয়ে গেছি। নামাজ আদায় শেষে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে দিলাম মসজিদের ব্যাপারে।

মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত, কোন এক অমাবস্যার রাতে জিন-পরীরা এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এলাকাটি পছন্দ হয়। মাটিতে নেমে এসে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে, কিন্তু গম্বুজ তৈরির আগেই ভোর হয়ে যাওয়াতে কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায়। ফলে গম্বুজ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকে অসাধারণ কারুকার্য খচিত মসজিদটি। আর এ বিশ্বাসের কারণে মসজিদটি সবার কাছে জিনের মসজিদ নামে পরিচিত।

তবে এর আসল নাম ছোট বালিয়া জামে মসজিদ। এটি নির্মাণের সঠিক সাল নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও এর গায়ে ১৩১৭ বঙ্গাব্দ মানে ১৯১০ সাল লেখা। স্থানীয় মানুষ ও মেহের বকসের আত্মীয়-স্বজনদের মতে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বালিয়া মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং মেহের বকসের মৃত্যুর সময়েই মসজিদটির বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়।

মেহের বকস চৌধুরীর ষষ্ঠ প্রজন্মের বংশধর বৃদ্ধ আফগান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের প্রথম পুরুষ নির্মাণ কাজ শুরু করলেও তিনি কাজ শেষ করতে পারেননি। এরপর ১৪০ বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় মসজিদটি পড়ে থাকে। এজন্য লোকে জিনের মসজিদ বলেন, যা সঠিক নয়। এরপর মেহের বকসের ছেলের পৌত্র বসরত আলী চৌধুরীর মেয়ে তসরিফা চৌধুরী আমাদের ফুপু তিনি অসমাপ্ত কাজ প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহায়তায় নির্মাণ শেষ করেন।

জানা যায়, জমিদার মেহের বকস চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বালিয়াতে এক মসজিদ তৈরির পরিকল্পনা করেন। এই জন্য দিল্লির আগ্রা মতান্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি আনা হয়। মুঘল স্থাপত্যের রীতির নকশায় মসজিদ তৈরি করাটা ছিল অনেক জটিল ও অনেক সময়ের ব্যাপার। হঠাৎ প্রধান স্থপতির মৃত্যুর ফলে মসজিদ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। মেহের বকস স্থানীয় কারিগরের সহায়তায় পুনরায় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কিন্তু স্থানীয় কারিগররা মসজিদের গম্বুজ নির্মাণে ব্যর্থ হন। ১৯১০ সালে মেহের বকস চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।

মেহের বকসের ছোট ভাই কয়েক বছর পর মসজিদটি নির্মাণের জন্য আবারো উদ্যোগ নেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না করে তিনিও মৃত্যুবরণ করেন। ফলে মসজিদটি ১০০ বছর গম্বুজ ছাড়াই দাঁড়িয়ে থাকে।

অবশেষে মেহের বকস চৌধুরীর প্রপৌত্রী তসরিফা খাতুনের উদ্যোগে ও প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহায়তায় ২০১০ সালে বালিয়া মসজিদটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংস্কার কাজের তত্ত্বাবধায়ন করেন শিল্পী কামরুজ্জামান স্বাধীন এবং জাকিরুল হক চৌধুরী। একই সাথে আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল এর নকশায় নতুনভাবে গম্বুজ নির্মাণ করা হয়।

চুন-সুরকি-লাল ইটের নান্দনিক এই মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন ভিড় করেন শত শত মানুষ।

পঞ্চগড় থেকে দেখতে এসেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, এসেছি মসজিদটি দেখতে। মুসলিমের ইতিহাস কতটা সমৃদ্ধ ছিল, তা এই মসজিদ দেখলে বোঝা যায়। খুব ভালো লেগেছে।

অনেকের কাছে শুনেছি পুরাতন মসজিদটির ব্যাপারে। আসবো আসবো বলে আসা হচ্ছিল না, ফাইনালি আজ এসে খুব ভালো লাগছে। পাকা রাস্তা থেকে মসজিদে আসার রাস্তাটাও পাকা করা উচিত বলে মনে করেন দর্শনার্থী আজিজুল হক।

এই মসজিদের ইমাম বলেন, ১১ বছর ধরে এখানে ইমামতি করছি। প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন এবং তারা জানতে চান। এটা আসলেই জিনের মসজিদ কি না। এটি কোনো জিনের নয়, এটা মানুষের ভ্রান্ত ধারণা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ছাফদার আলী কলেজ।

টাঙ্গাইল/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়