ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সুইডেনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা 

মো. মঈন ঊদ্দিন সাব্বির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০০, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:০৬, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১
সুইডেনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা 

উচ্চশিক্ষা আর উন্নত জীবনব্যবস্থা কে না চায়। সবাই কমবেশি স্বপ্ন দেখে নিজের জীবনটা ভালো পরিবেশ এবং উন্নত ব্যবস্থায় কাটাতে, যাতে চলার পথ হয় মসৃণ। ভারতের প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং পরমাণু বিজ্ঞানী আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন সেটাই যেটা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না’। এমনই এক স্বপ্ন দেখা থেকে শুরু হয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ইরতাজুর রহমান ইমনের পথচলা।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে বাকি বন্ধুরা যখন পেশাগত জীবন নিয়ে সামনে অগ্রসরের চিন্তা করছে, তখন ইমন চিন্তা করেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাইরের দেশে যাওয়ার। জানতেন, সবকিছু ওতটা সহজ হবে না, কারণ চারপাশে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা। তারপরও শক্ত মনোবল এবং একরাশ আশা নিয়ে খোঁজ নিতে থাকেন কোথায় করতে পারেন তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, কোথায় মিলতে পারে তার স্বপ্নের খোঁজ!

এরই মধ্যে ২০১৭ সালের শেষের দিকে সম্পন্ন করে নেন IELTS। ইচ্ছা ছিল ইউরোপের কোনো দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের; কারণ ইউরোপের পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং শিক্ষাব্যবস্থা বরাবরই তাকে মোহিত করে। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের কথা; এমনই এক সুযোগ এসে ধরা দেয়, যখন দেখতে পান সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাইরের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সার্কুলার ছেড়েছে। দেরি না করে তৎক্ষণাৎ অ্যাপ্লাই করে ফেলেন। ইমন বলেন, সুইডেনে কেউ পড়তে চাইলে একসঙ্গে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করতে পারে। কোর্স নির্বাচন, পুর্ববর্তী শিক্ষাগত যোগ্যতা, IELTS স্কোর এবং ব্যাংক-ব্যালেন্সের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় সু্যোগ। প্রসেসিং সময় কখনো কখনো ১ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে, যা ধৈর্যসাধ্য কাজ। তাছাড়া সুইডেনের ভিসা প্রসেসিং সেন্টারে অনেক বেশি ভিড় থাকায় কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসেপ্ট লেটার পেয়েও থাকেন, তাহলে তিনি যাতে ভিসার জন্য আগেভাগেই অ্যাপ্লাই করেন। 

সুইডেন অ্যাম্বাসি কর্তৃপক্ষ ভিসার সাক্ষাৎকারের জন্য সময় নির্ধারণ করতে শুধু ফোনেই কথা বলে। ইমন বলেন, আমার ভাগ্য সহায় ছিল, কেননা ভিসা কনফার্ম হতেও এক মাস সময় লাগে আর আমি সময় মতো আমার ভিসা পেয়ে ক্লাস শুরুর আগেই সুইডেনে পৌঁছাতে পেরেছি। কেননা, এখানকার নিয়ম-কানুন এত কঠোরভাবে মানা হয় যে, কেউ যদি প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে কাগজপত্র জমা দিয়ে ক্লাসের অনুমতি পাওয়ার জন্য দেরি করেন, তাহলে তার ভর্তি বাতিল হতে পারে এবং অগ্রিম জমাকৃত ফিস থেকে বেশ ভালো অংকের টাকা জরিমানা হিসেবে কেটে রাখা হতে পারে।

ইরতাজুর রহমান ইমন পড়ালেখা করছেন University of Gothenburg এর Masters in Communication বিষয়ে। তিনি বলেন, এখানকার পরিবেশ অনেক বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একেকটা বিভাগের ক্যাম্পাসের পরিধি বেশ বড়। প্রতিটি ক্যাম্পাসে ফ্রি ওয়াইফাই কাভারেজ এবং ডিজিটাল যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত। ক্লাসরুমগুলো প্রশস্ত, খাবারের ক্যান্টিন বেশ ভালো ডেকোরেটেড। এখানে রয়েছে বিশাল বিশাল লাইব্রেরি, যেখানে কেউ চাইলে যতক্ষণ ইচ্ছা পড়ালেখা করতে পারেন। শিক্ষকরা অনেক বেশি হেল্পফুল এবং বিনয়ী। সুইডিশরা আচার-আচরণের দিক দিয়ে অনেক বেশি ফর্মাল, তবুও এই ফর্মালের মধ্য দিয়েই চলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন পাঠদান। 

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে যেমন নির্দিষ্ট কিছু ড্রেসকোডের বাইরে পোশাক পরা যায় না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এখানে তেমনটি হয় না। শিক্ষার্থীরা কেউ চাইলে টিশার্ট এবং হাফপ্যান্ট পড়েও ক্লাসে আসতে পারেন। শিক্ষকরা এত বেশিই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন যে, কারো কোনো প্রকার সমস্যায় নিজে থেকে সাহায্য করেন, থাকে কাউন্সেলিংয়ের সুযোগ। এখানকার পরীক্ষাগুলো ক্লাস হওয়ার চেয়ে অনলাইনে নেওয়াটাই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। পরীক্ষাতে শিক্ষার্থীদের কোড নম্বর প্রদান করা হয়, নাম আইডি না থাকার কারণে খাতা দেখা এবং মার্কস দেওয়ার ব্যাপারটা এখানে অনেক বেশি স্বচ্ছ। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে ইমন জানান, সেখানে একই কোর্সে অনেক বাঙালি শিক্ষার্থী পেয়ে যাওয়াতে, তার জন্য খাপ খাইয়ে নেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। বাঙালি ছাড়াও তার আফ্রিকান এবং ইউরোপিয়ান অনেক বন্ধু রয়েছে।  

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, এখানে ঘুরে দেখার মতো হেরিটেজ জায়গা তেমন একটা নেই, তবে সুইডেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা একটি দেশ। এখানে অনেক লেক রয়েছে, রয়েছে জানা-অজানা গাছে ঘেরা ভ্যালি, রয়েছে এলাকার পর এলাকা পাহাড়। সমতল জায়গা এখানে কম, মানুষের বসবাসের জন্য রয়েছে পাহাড়ের উপরের তৈরি করা বাড়ি। পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে চলাচলের জন্য রাস্তা। 

এখানে দিন-রাত্রির তফাৎ অনেক বেশি, দিনের সময় অল্প, বড়জোর ৬-৮ ঘণ্টা। আবহাওয়া অনেক বেশি ঠান্ডা যে, অনেকগুলো শীতবস্ত্র পরে থাকলেও সেই ঠান্ডা নিবারণ করা মুশকিল। বেশির ভাগ সময় বৃষ্টি পড়ে এবং বৃষ্টির কারণে ঠান্ডা আরো বেড়ে যায়। ইমন জানান, এখানে এসে প্রথমেই আমাকে আবহাওয়ার সঙ্গে এক প্রকার লড়াই করতে হয়েছে খাপ খাওয়ানোর জন্য। কারণ, বাংলাদেশে তো আমরা এমন পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত নই। এখানে দীর্ঘ দিন সূর্যের আলোর দেখা মেলে না, প্রচণ্ড শীতে কখনো কখনো স্নো পড়ে আর সবকিছু বরফে ঢেকে যায়, চলাফেরা করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

তিনি জানান, ছেলেদের দৈনন্দিন কাজ শেখাটা অনেক বেশি জরুরি, কেননা আপনি যদি প্রবাসে আসতে চান তাহলে আপনাকে সব কিছু নিজ হাতে করতে হবে। বাজার করা, রান্না করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিল দেওয়া সবকিছুই নিজের কাজ। এখানে সব কিছু আইটি এবং টেকনোলজি ভিত্তিক। ক্যাশ বিনিময় হয় না বললেই চলে। খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু পাওয়া যায়। বাঙালি এবং উপমহাদেশীয় অন্যান্য খাবারের রেস্তোরাঁ রয়েছে। তবে খরচ বাঁচাতে কমবেশি সবাই বাজার করে রান্না করে খেতেই অভ্যস্ত। শিক্ষার্থীরা একত্রে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। আনন্দ-আড্ডা, কালচার বিনিময় সব কিছুই হয় তাদের মাঝে।

সুইডেনে শিক্ষার্থীদের আয়ের সুযোগ অনেকটা কঠিন। এখানে কাজ করার জন্য সহজে ওয়ার্কপারমিট দেওয়া হয় না। কোথাও কাজের জন্য আবেদন করতে গেলেও কোর্সের ৩০-৬০টি ক্রেডিট সম্পন্ন থাকতে হবে এবং ওয়ার্কপারমিট পেতে হলে প্রভাবশালী মাধ্যমে পরিচিতি থাকা প্রয়োজন। তবে কেউ ওয়ার্কপারমিট পেয়ে গেলে তার জন্য শিক্ষাখরচ ফ্রি করা হয়, দেওয়া হয় সরকারি অনেক সুযোগ-সুবিধা। সঙ্গে পেয়ে যায় Pair Visa আবেদনের সুযোগ। 

অর্থনৈতিকভাবে এদিক দিয়ে লাভবান না হওয়ার জন্য সুইডিশ সরকার অনেকটা অনীহা প্রকাশ করে ওয়ার্কপারমিট দেওয়ার ক্ষেত্রে। তাই কাউকে ভিসা পেতে হলে পোহাতে হয় অনেক ঝক্কি-ঝামেলা। ইমন বলেন, এখানে বাঙালি কমিউনিটি থাকাতে আমার জন্য তাদের সঙ্গে কাজ করে আয় করা অনেকটা সহজ হয়েছে। এখানের জীবন উন্নত হলেও নিজের জীবিকা নির্বাহ, একাকিত্ব কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ এবং পড়ালেখাতেই ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। 

সুইডেনে মুসলিমদের সংখ্যা অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশ থেকে বেশি। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কারণে রিফিউজিদের বড় একটি অংশ আশ্রয় পেয়েছে এই দেশটিতে। ইমন বলেন, প্রবাসজীবন বাইরে থেকে দেখতে এবং গল্প শুনতে ভালো লাগলেও এখানে যারা আসেন, তাদের জীবনে তেমন কোনো আনন্দ নেই, তৃপ্তি নেই। যতদিন প্রবাসে থাকবে, তত দিন কাজ করে যেতে হবে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য। 

যতটা চাকচিক্য রয়েছে, ততই রয়েছে মন খারাপ করা ব্যাপারও। তাই যতটুকু পারা যায় নিজেকে ব্যস্ত রেখে এবং অবসর সময়ে আড্ডা দিয়ে যতটা মন ভালো রাখা যায়, তাতেই স্বস্তি। যদিও সুইডিশরা মানবিক দিক দিয়ে হেল্পফুল, তবুও বাঙালিদের মতো ওতটা আন্তরিকতার পরিবেশ নেই, যেমনটা আমরা পেয়ে অভ্যস্ত।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়