ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ফেলে আসা দিনগুলো 

আল আমিন ইসলাম নাসিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১  
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ফেলে আসা দিনগুলো 

ইচ্ছা ছিল বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে পড়বো। কলেজ পছন্দের জন্য কম্পিউটার দোকানে যেতে হবে কাল-পরশু। এদিকে আমি অনবরত ফেসবুকে সার্চ দিচ্ছি আশেপাশে কি কলেজ আছে? বলতে পারেন এসবের পেছনের কারণ আমার বয়স, আর বয়সের দোষে দুষ্টু আমার কৌতুহল। 

ভাবনার বাইরে ছিল কেসি কলেজে পড়বো। গেলাম কলেজ চয়েজ দিতে, পাশের গ্রামের পরিচিত ভাই কম্পিউটার দোকানদার (বর্তমানে সম্রাট এন্টারপ্রাইজ এর পাশে অবস্থিত ফ্লাক্সির দোকান, এখন উনি নেই)! তো গিয়ে বললাম, প্রথমে কেসি কলেজ তারপর অন্যান্য বাইরের কলেজ চয়েজ দেবেন। সবকিছু কমপ্লিট, এখন বাড়িতে এসে আম্মু-আপুর সঙ্গে কথা বলছি।

এদিকে আমার একমাত্র বোনও সরকারি কলেজে অনার্স পড়ছেন। তো বাড়ির সদস্যদের কথোপকথনের মধ্যে হঠাৎ আপু বলছেন, ভুল করলি, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ আগে দেওয়া উচিত ছিল। আম্মুও বলছে। বুঝলাম না, তারা কি আমাকে ভূগোল বুঝাচ্ছেন, নাকি আমাকে দূরে যেতে দিতে চাইছেন না। একদিন পর হঠাৎ খামখেয়ালি মনে উদয় হলো, ‘না’ সরকারি কলেজেই পড়ি, এদিকে চান্স হবেও কিনা জানি না আমি। তারপর তাৎক্ষণিকভাবে আমার দূরে যাওয়ার পরিকল্পনা হাঁটে হাড়ি ভাঙল। অবশেষে কল দিলাম কম্পিউটার ভাইয়ের কাছে, ‘ভাই, আমি কলেজ চয়েজ পরিবর্তন করবো, করা যাবে কি না, উনি বললেন হ্যাঁ।

নদী পেরিয়ে রৌদ্রের মধ্যে আবার গেলাম আপুর সঙ্গে কলেজ চয়েজ দিতে। এদিকে প্রথম কলেজ চয়েজ দিলাম কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ এবং পরে পুলিশ লাইনসহ অন্যান্য। তাও দু’একটা বাইরে দিলাম, বাইরে যদি চান্স হয়। কলেজ চয়েজের রেজাল্টের পর চান্স পেয়ে গেলাম টেক্সের মাধ্যমে। ইয়েস, ইউ হ্যাভ সিলেক্টেড ফর ‘কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ’! আপুকে সাথে সাথে কল করে জানালাম, সে তো ভীষণ খুশি, তখন হয়তো সে কলেজে ছিল, পাশে তার বান্ধবীও ছিল। জোরে একটা চিৎকার দিয়ে অভিনন্দন জানাল। আমি বাড়িতেও জানালাম। 

সবাই এমনভাবে ট্রিট করছেন, যেন আমি অক্সফোর্ডে চান্স পেয়েছি। অতঃপর ভর্তি হতে আপুর সঙ্গে গেলাম, লাইব্রেরিতে লাইন আর কাউন্টারে টাকা আর কম্পিউটার টু কলেজ, কলেজ টু কম্পিউটার দৌড়ানি দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম কুষ্টিয়া সরকারি কলেজেই।

কিছু দিনের মধ্যেই ক্লাস শুরু হবে আর এদিকে আমি ঢাকা পিজিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে বাবার সঙ্গে রোজ দৌড়াদৌড়ি নিয়ে ব্যস্ত। অবশেষে ২০ জুলাই অর্থাৎ কুঁড়ি দিন পর থেকে শুরু হয় আমার কলেজ জীবনের প্রথম দিন। এদিকে বন্ধু মামুন হোসেনের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই যোগাযোগ থাকতো! ওর সাথে কথা বলেই ২০ জুলাই ২০১৭ প্রথম কলেজে যাই। প্রথম দিন কয়েক জন বন্ধু বানালাম, এর মধ্যে সুমন, জয়। 
প্রথমেই শুরু হতো সাত সকালে ইংরেজি ক্লাস। স্যার রোজ প্রশ্নপত্র আনতো, যে ভালো পাড়তো তাকে জিজ্ঞেস করতো স্কুল, বাড়ির কথা। আমি ততটা না পারলেও মনোযোগ মোটামুটি ছিল বলবো। এরপর কালো একটা স্যারের বাংলা ক্লাস চলতো, লাইট অন, দরজা অফ। মনে হতো প্রেশার কুকারের মধ্যে ক্লাস চলতো। চরম বিরক্তিকর লাগতো, যার জন্য ক্লাস বেশি করতাম না।

যাইহোক আমি তবে ‘ক’ সেকশনে ছিলাম। এদিকে পৌরনীতি ম্যামের মনোরম ক্লাস, অর্থনৈতিক ক্লাসে স্যারের ক্লাস, আর মা নামধারী শ্রদ্ধেয় তাহেরা ম্যামের সমাজবিজ্ঞান সব মিলিয়ে সুন্দর, এক কথায় সুন্দর লাগতো ক্লাসগুলো। তবে ভূগোল ম্যামের ক্লাসে সবাই মাত্রারিক্ত বিরক্ত হলেও আমি খুব মজা নিতাম ক্লাসে এমনকি ভূগোল স্যারের ক্লাসেও। তবে বকা শুনতে হয়েছে ভূগোল ম্যামের কাছে বেশ। ক্লাস না করায় স্যারের আমার ফোন কেড়ে নেওয়াও একটা চরম রোমাঞ্চকর ঘটনা ছিল বলতেই হয়। 

এবার আসি Ragging-এ, হ্যাঁ Rag খেয়েছি ভালোই, বিশেষ করে এখানে না বসে ওখানে বস, উঠে যা এসব, একদিন আমাদের এক বন্ধুই Rag দিয়েছিল আমায় আর সুমনকে। ধাক্কা লেগেছিল সুমনের সঙ্গে, বললো কোন ইয়ারের, বাসা কোথায়, পকেটে টাকা আছে কি না? আর এদিকে সুমন মহোদয় বিনীতভাবে বললেন, ভাই ১০ টাকাই আছে, বাড়ি যাওয়ার ভাড়া।

আর ওই টাকাটা নিয়ে ওয়ার্নিং দিয়েই চলে গেলেন। কিছু দিন পরে জানতে পারি ও আমাদেরই বন্ধু, সেন্ট্রাল কলেজে পড়ে। এখন বেশ ভালোই পরিচিত। এভাবেই চলতে লাগল, তবে খুব একাকি অনুভব করতাম কলেজে গিয়ে, কেননা আমার স্কুল থেকে আমি ছাড়া কোনো ছেলে আর সেখানে নেই। স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে নতুন কলেজে তেমন একটা ভালোও লাগতো না। 

একটা মজার কাহিনি বলি, আমার দু’ক্লাস ছোট ভাইকেও আমার ক্লাসে এনে ক্লাস করেয়েছি। আবার আমার এক বন্ধু তখন মাগুরা কলেজে পড়তো, ওকেও এনে ক্লাস করাতাম আমার ক্লাসে। কলেজের প্রথম বর্ষের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষাই দেইনি আমি। এরপর আসি আইসিটি ক্লাসের বকশী স্যার। যদিও স্যার মানুষটি খুব রসিক (যার ইচ্ছে ২য় বার পড়ার সুযোগ থাকলে সাহিত্য নিয়ে পড়া)। তবুও ভয় করতো তার ক্লাস, এদিকে আইসিটির ‘আই’ না পারা টানা দু’বছরে তিনটি ক্লাস করেছি তার বৈকি।

ক্যাম্পাসের Rag day ও সুন্দর কাটিয়েছি সবার সঙ্গে। এভাবেই ভালোই চলছিল বন্ধু, ক্লাস, সরকারি কলেজের ছুটি এসব নিয়ে। তারপর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ৬ দিন আগে মোটরসাইকেলে এক্সিডেন্ট, আহা। দিনটি ছিল ২৬ মার্চ ২০১৯। ৪/৫ দিন পরে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে পরীক্ষা দিলাম এইচএসসি-১৯। পরীক্ষার আগে হাসপাতালের বেডেও পড়তে বসেছি, মনে আছে। একঝাঁক কলেজের বন্ধু-বান্ধবীসহ অন্যরা দেখতে এসেছিল। অতঃপর মহিলা কলেজে সিট পড়ললো। মহিলা কলেজে পরীক্ষার মাঝে বন্ধু রনি (সেনাবাহিনী), বন্ধু সজল, রনি, আরফিন সাইয়ন এরা খুব সাহায্য করেছে দৈনিক। 

যাহোক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর রেজাল্ট পেলাম এবং রেজাল্ট ছিল এ+, জানালাম আম্মু আব্বু সবাইকে, সবাই খুশি, আমি খুশি। এইতো এখনো যাই কলেজের পুকুর পাড়ে, মিলন মামা, শরীফ মামার দোকানে, মুক্ত মঞ্চে বসি।

অদ্ভুত এক রহস্যময় মায়া এই কলেজে, এখন খুব মিস করি ক্যাম্পাসসহ সবাইকে। এই কলেজের মায়া থেকে এখন কুষ্টিয়ার শহরেরও মায়ায় পড়েছি। যাইহোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মাঝে সমাজবিজ্ঞান বিভাগেও ভর্তি হয়েছিলাম এখানে। সব মিলিয়ে এখন ভালোবাসি কলেজকে, হ্যাঁ সেই খুব দূরে যাবো ভাবা থেকে রেজাল্ট পাওয়া পর্যন্ত সময়টাকে ভালোবাসি। যাইহোক ক্যাম্পাসের সব কিছুই এখন স্মৃতি। সর্বোপরি, একটি কথা কলেজ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, ‘কখনো কখনো আমরা কোনো মুহূর্তের আসল মান বুঝতে পারি না, যতক্ষণ না এটি স্মৃতি হয়ে যায়।’

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়