নীরবেই বসন্তের আগমন জাবি ক্যাম্পাসে
ইমন ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
ফাগুনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শীতের বিদায়ী বিকেলে উত্তরের দড়জা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকৃতিকে নতুন রূপে সাজাতে দখিনা দুয়ারে কড়াঘাত করছে বসন্তের ঠান্ডা শীতল হাওয়া। গাছে গাছে নতুন কচি পাতার সমারোহ আর বাহারি রঙের ফুলে মেতে উঠেছে প্রকৃতি। কোকিলের কুহু ডাকে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠেছে।সেই সাথে মুখরিত হয়ে উঠেছে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
প্রতিবছর বসন্তের এই সময়টাতে ভিন্নরূপে সেজে ওঠে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রয়েছে ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। শত শত গাছপালা, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বন্যপ্রাণী আর সবুজের সমারোহ বুকে ধারণ করে প্রকৃতির বুকে এক খণ্ড ভূমি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ সৌন্দর্য মন কারে সব ক্যাম্পাস প্রেমীদের।
বসন্তকালে ক্যাম্পাসের প্রকৃতি যেন নতুন রূপ ধারণ করে। রুক্ষ-শুষ্ক শীতের করুণ মায়ায় ক্যাম্পাসের গাছপালা পাতা শূন্য হয়ে পড়ে, পাখিরা কণ্ঠ হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতিতে বিষন্নতা বিরাজ করে। ক্যাম্পাসিয়ানদের প্রেমের অনুভূতিগুলো হারিয়ে ফেলে। শিক্ষার্থীরা সঙ্গীতের সুর খুঁজে পায় না বলে সংগীতের সৃষ্টি হয় না। চারপাশের অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে যেন নতুন মাত্রা খুঁজতে থাকে ক্যাম্পাস প্রেমীরা। জমে না বটতলার আড্ডা, টারজান পয়েন্টের হাসি-ঠাট্টা। টিএসসিতে বসে না নৃত্যের আসর, লন্ডন ব্রীজের আসেপাশে হয় না আর প্রেমিক প্রেমিকাদের হাসি-কান্না আর ঝগড়ার তামাশা।
চৌরঙ্গীর পুকুর পাড়ে আর মাছেরা ভিড় জমায় না। যে জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের প্রেমে পড়ে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমাতো, আজ সেই পর্যটকরা শীতের রুক্ষতার কাছে হার মেনে বসে আছে বসন্তের অপেক্ষায়। কবে আসবে বসন্ত? কবে আবার প্রকৃতি সাজবে নতুনরূপে। এভাবেই জল্পনা আর কল্পনায় ছবি আঁকতে থাকে আর প্রহর গুণে সময় পার করতে থাকে ক্যাম্পাস প্রেমীরা।
শীতের রুক্ষ বাস্তবতা পরিবেশকে করেছিল মর্মাহত। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছিল। ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। দেশের ৬টি ঋতুর মধ্যে বসন্ত অন্যতম। বসন্তকে বলা হয়ে থাকে ঋতুদের রাজা। ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুমাস নিয়েই বসন্ত। শীতের রুক্ষতা ও শুষ্কতা শেষে বসন্তে প্রকৃতি নতুনরূপে সেজে ওঠে। শীতের শুষ্কতায় পাতা ঝড়া গাছগুলোতে নতুন সবুজ কচি পাতা গজায়, নতুন রঙ-বেরঙের ফুল ফোটে, ফল জন্মায়। আম গাছের ডালে ডালে কচি মুকুলে ভড়ে উঠেছে। নতুন গজানো এই মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে ভড়ে উঠেছে প্রকৃতি। মৌমাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মধু আহরণে। সত্যি বসন্তের ছোঁয়ায় প্রকৃতিতে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে চলেছে।
ফাগুনের রূপ বৈচিত্র্যের খেলায় বন্য প্রাণীরা মেতে ওঠে। ফাল্গুন মাসের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো এক মাসে আবহাওয়া জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ফাগুনের আবহাওয়া প্রকৃতির বুকে নতুন মাত্রা যোগ করে। ফাল্গুনের এলোমেলো হাওয়ায় কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়ার সাজে সজ্জিত বসন্ত ঋতু তার আপন রূপ মাধুর্যের ছোঁয়ায় ও বৈচিত্র্যে দিয়ে সব ঋতুর মধ্যে ঋতু রাজের স্থান দখল করে নিয়েছে। দীর্ঘ বিরতির পর আবারো এসেছে বসন্ত তার আপন রূপে প্রকৃতিকে রাঙাতে। ক্যাম্পাসের লম্বা লম্বা গাছগুলোতে নতুন কচি পাতা গজাতে শুরু করেছে।
কৃষ্ণচূড়া, লাল পদ্ম, ক্যাসিয়া রেনিজেড়ার মতো হরেক রকমের ফুল আর কচি পাতার সবুজ রঙের সৃষ্ট আভায় প্রকৃতি পেয়েছে নতুন রূপ, নতুন গতি, নতুন মাত্রা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা অনুষদের সম্মুখভাগে অবস্থিত মহুয়া তলার মহুয়া গাছে ফুটেছে নতুন ফুল। যে ফুলের শোভা পেতে প্রতি বছর বসন্তের এই সময়টাতে মহুয়াতলায় বসে বসন্ত বরণ উৎসব। কোকিলের কুহু ডাকে ভড়ে ওঠে ক্যাম্পাসের আশপাশ। কোকিলের কুহু ডাক বসন্তের আবির্ভাবকেই স্বাগত জানায়। বসন্তের অপূর্ব সৌন্দর্য ক্যাম্পাসের প্রকৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।
ক্যাম্পাস প্রেমীরা নতুনভাবে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে শেখে। সংগীত প্রেমীরা বসন্তের গান রচনা করার সুর খুঁজে পায়। প্রেমিক-প্রেমীকারা নতুন করে প্রেমের জাল বুনতে শুরু করে। বসন্তের আগমনে সাহিত্য প্রেমীরা সাহিত্য রস খুঁজে পায়। ক্যাম্পাস প্রেমীরা নতুনরূপে নিজেদের সাজাতে শুরু করে। অথচ মহামারি করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে গত বছরের মার্চ মাস থেকে বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ফাঁকা ক্যাম্পাসে নেই শিক্ষার্থীদের মিলন মেলা। শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিতে ক্যাম্পাসে যেন স্থবিরতা বিরাজ করছে। নেই কোনো হাঁসি-ঠাট্টা, রঙ-তামাশা। বসন্তের আগমনে যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ মিছিল হবার কথা ছিল, সেখানে যেন কান্নার রোল বিরাজ করছে। বসন্ত আছে ঠিকই, তবে বসন্তকে বরণ করবার নেই কেউ।
ক্যাম্পাসে বসন্ত আছে ঠিকই তবে বসন্তের রেস নেই কোথাও। প্রকৃতির বিচিত্র এই রূপ যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। ফাগুনের হাওয়ায় কৃষ্ণচূড়া দোল খাচ্ছে। বাহারি রঙের প্রজাপতিদের সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে বসন্ত বরণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ধরনের শোভাযাত্রা বের করা হয়। বসন্ত প্রেমীরা বাহারি রঙের পোশাক পরে বসন্ত বরণ উৎসবে মেতে ওঠে। তরুণ-তরুণীরা বসন্তের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে তোলে। বসন্ত এসেছে, অথচ আজ বসন্ত বরণের নেই কোনো প্রস্তুতি। বসন্ত প্রেমীরা সাজবে না নতুন পোশাকে। বাহারি রঙের ফুলের গন্ধে নিজদের সুবাসিত করবে না। সব মিলিয়ে এক মর্মাহত বসন্তের সূচনা হতে চলেছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আরো পড়ুন