ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

৩ কৃষ্ণাঙ্গ নারীর বদলে যাওয়া জীবন

মো. মঈন উদ্দিন সাব্বির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩১, ১ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৪:৩৪, ১ মার্চ ২০২১
৩ কৃষ্ণাঙ্গ নারীর বদলে যাওয়া জীবন

২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে কমলা হ্যারিস ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে সারাবিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে বহন করছে। 

আমেরিকার দীর্ঘ ইতিহাসে মার্টিন লুথার কিং ছাড়া কোনো কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ কিংবা নারী স্বাধিকারের পক্ষে আওয়াজ প্রকাশে লক্ষণীয়ভাবে নিজেদের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারেননি। যদিও কমলা হ্যারিস আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নন, তিনি দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ান বংশোদ্ভূত। রাজনীতি ছাড়াও আমেরিকান ব্যবসায়িক সেক্টরেও কৃষ্ণাঙ্গরা নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেননি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সমস্ত মার্কিন করপোরেটে কার্যনির্বাহী এবং সিনিয়র নেতৃত্বের পদে কেবল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গই আসীন হতে পেরেছেন।

ফরচুন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী আজ অবধি পুরো ইতিহাসে কেবল ১৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ সিইও রয়েছেন, যার মধ্যে ১৭ জন পুরুষ এবং ২ জন মহিলা। আসন্ন ১৫ মার্চ ফরচুনের ৫০০ সিইওর তালিকায় তৃতীয় কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে ওয়ালগ্রিনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রোজালিন্ড ব্রুয়ারের নাম যুক্ত হতে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ কর্মজীবী নারীদের মাঝে ব্যবধান কমাতে বেশিরভাগ সংস্থাগুলোতে নির্বাহী নেতৃত্বে পর্যাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ নারী নেই। উভয়ের মাঝে সমতা রক্ষায় এদিকে মনোযোগ দেওয়াটা জরুরি।  

ব্ল্যাক হিস্ট্রির সম্মানে; সিএনএন, বিজনেস করপোরেট আমেরিকার সর্বোচ্চ র্যাংকিংয়ের কৃষ্ণাঙ্গ তিন নারীকে ফিচার করেছে, যেখানে সংক্ষিপ্ত আকারে তাদের ক্যারিয়ার, অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শগুলো তুলে ধরা হয়েছে। রাইজিংবিডির পাঠকদের উদ্দেশে সেগুলো শেয়ার করা হলো।

জেসমিন অ্যালেন

জেসমিন অ্যালেন, হেনেসি ময়েটে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন নামিদামি কোম্পানিগুলোতে। মার্কেটিং বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জেসমিন বলেন, নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা খুব জরুরি। ক্যারিয়ার নিয়ে দ্বিধায় থাকবেন না। আপনি যদি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে আপনি কোনো কাজে সফল হবেন, তাহলে আপনার সেটাই করা উচিত। কারণ, আপনাকে আপনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।

জেসমিন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে হেনেসির মার্কিন পরিচালনা পর্ষদে যোগদান করেন। তিনি ব্র্যান্ডটির সর্বোচ্চ র্যাঙ্কের কৃষ্ণাঙ্গ কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা। বর্তমানে কোম্পানিটির ব্র্যান্ডিং, ইক্যুইটি এবং লভ্যাংশ বৃদ্ধির জন্য কাজ করছেন। জেসমিন তার ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন অ্যালকোহল এবং সফট ড্রিঙ্কস বিপণনের বিভিন্ন কৌশল প্রণয়ন এবং উন্নয়ন করার পেছনে। ওয়াইন এবং স্পিরিট নিয়ে অ্যালেন বেশ কয়েকটি সফল ক্যাম্পেইন করেছিলেন, যা ব্র্যান্ডগুলোর পরিচিতি বাড়িয়েছিল। তিনি কোকা-কোলাতেও আট বছরের বেশি সময় কাটিয়েছিলেন। ২০১০ সালের শীতকালীন অলিম্পিক এবং ফিফা বিশ্বকাপের জন্য কাস্টমাইজ দাসানি বোতলজাত পানির প্যাকেজিংয়ের নকশাও তিনি করেছিলেন।

জেসমিনের বর্তমান প্রতিষ্ঠান এবং অন্য বৃহত্তর বিলাসবহুল পণ্যের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গ ফ্যাশন ডিজাইনার এবং ব্যবসায়ের কার্যনির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে উদাসীন থেকেছে। কোম্পানিগুলো তাদের লভ্যাংশের আশায় বাজারজাত পণ্যগুলোতে ব্ল্যাক কালচারাল থিম এবং ব্ল্যাক সেলিব্রিটিদের ব্যবহার করেও সমালোচিত হয়েছে। তবে এসব ব্যর্থতা ও সমালোচনা কখনই জেসমিনকে তার লক্ষ্য থেকে বিরত রাখতে পারেনি। বৈশ্বিক মহামারিতে যেখানে কমবেশি সব প্রতিষ্ঠান মুখথুবড়ে পড়েছে, সেখানে জেসমিনের হাত ধরেই তার প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 

তিনি তার শিক্ষাজীবনে বিদ্যালয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সিনিয়র শ্রেণির সভাপতি হওয়ার জন্য নির্বাচন করেছিলেন। নানা প্রতিকূলতার সত্বেও তিনি ক্যাম্পেইন অব্যাহত রেখেছিলেন। 

জেসমিন বলেন, আমার বাবা একবার আমাকে বলেছিলেন ‘জেসমিন! কোথাও কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, তার মানে যে সেখানে নতুন করে কিছু হতে পারবে না, তা কখনো নয়।’ আমার বাবার সেই কথাগুলোই আমাকে কাজের প্রেরণার উৎস হিসেবে অধ্যবসায়ী হতে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সাহায্য করেছে।

বনিতা সি. স্টুয়ার্ট

স্টুয়ার্ট কাজ করছেন গুগলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। টেক ইন্টাস্ট্রিতে তার অভিজ্ঞতা চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। তিনি গ্লোবাল পার্টনারশিপে বিশেষজ্ঞ। 

স্টুয়ার্ট তার স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা হিসেবে গুগলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১২ সালে। তিনি গুগলের গ্লোবাল পার্টনারশিপ দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা অনুসন্ধান, মোবাইল অ্যাপস, সম্প্রচার বাণিজ্য, সংবাদ,  টেলিযোগাযোগ এবং ডোমেনগুলো পরিচালনা করে থাকে। 

তিনি জানান, এইচআর ও অপারেশনস বিভাগগুলোর মতো অন্যান্য বিভাগেও কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের নিয়োগে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ক্যারিয়ারের প্রথম থেকেই তাদের ফিনান্সিয়াল ব্যাপারে দক্ষ হওয়া প্রয়োজন। ট্রেইনিংয়ের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন এবং অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরো অনেক স্পন্সর প্রয়োজন।

স্টুয়ার্ট তার ক্যারিয়ারে বহু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেছেন। যদিও তিনি বেশ কয়েকবার স্বীকার করেছেন যে, ব্যবসা তার ক্যারিয়ারের মূল পছন্দ ছিল না। স্টুয়ার্ট সিএনএন বিজনেসকে বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হওয়া। কারণ আমি হাভার্ডের স্কুল পত্রিকার বিজ্ঞাপন পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি, তখন থেকেই আমার সাংবাদিকতার প্রতি বেশ ঝোঁক। পরবর্তী সময়ে একাডেমিকভাবে আইন বিষয়ক স্কুল অথবা বিজনেস স্কুলের যেকোনো একটিতে যোগদানের কথা চিন্তা করেছিলাম। সত্যি বলতে জীবনে আরো বেশি ক্যারিয়ারের বিকল্প খুঁজে নিতে এবং কোনো সংস্থাকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করতেই বিজনেস স্কুল বেঁছে নিয়েছিলাম।

স্টুয়ার্টের প্রযুক্তি নিয়ে অভিজ্ঞতার শুরু ১৯৭৯ সালে, আইবিএমের বিপণন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে। ডেইমলার ক্রিসলার এজির সঙ্গে মোটরগাড়ি শিল্পে সফলভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে তিনি ২০০৬ সালে গুগলে যোগদান করেন। ক্রিসলারের ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিজ্ঞাপন এবং বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করে তিনি ২০০৫ সালে ইন্টারেক্টিভ মার্কেটার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছিলেন।

তার ক্যারিয়ারে সাফল্যের দীর্ঘ তালিকার মধ্যে রয়েছে ২০১৫ সালের গুগলের সঙ্গে হার্ভার্ড ওয়েস্ট টেক এক্সচেঞ্জের উদ্যোগ। নিজের বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে তিনি প্রজেক্টটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছিলেন। যদিও জেব্রু এবং কার্লি নামের দুজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা সংস্থাটিতে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিকূল কাজের পরিবেশ গড়ে তোলার মতো অভিযোগ তুলেছিল। স্টুয়ার্ট এবং গুগল কখনো জেব্রু এবং কার্লির অভিযোগ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে স্টুয়ার্ট বলেছিলেন, ২০২০ সালের মধ্যে তার সংস্থার দলটি উদীয়মান বিবর্তনের অংশ এবং তার ব্যক্তিগত গর্বিত সাফল্যগুলোর একটি হবে।

স্টুয়ার্ট জানান, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা হিসেবে আমি আমার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় পুরুষ নিয়ন্ত্রিত ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছি। যদিও এটি আমার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল, তবুও আমি আশাবাদি যে আমার পদক্ষেপগুলো বাকিদের জন্য উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে এবং এটা ভেবে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। প্রতিটি পদক্ষেপে সাহস সঞ্চার করেই এগিয়ে যেতে হবে।

সুসান চ্যাপম্যান-হিউজেস

সুসান আমেরিকান এক্সপ্রেসে নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি গ্লোবাল ডিজিটাল ক্যাপাবিলিটি, ট্রান্সফরমেশন ও ডিরেকশন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।

সুসান বলেন, আপনাকে সামনে থাকা সুযোগগুলোর ব্যাপরে মনোযোগী হতে হবে। কারণ, এই সুযোগগুলোই আপনাকে সামনে এগিয়ে যেতে এবং সবার নিকট স্বীকৃতি পেতে সাহায্য করবে। অন্যের থেকে কাজের সহযোগিতা এবং ফিডব্যাক পেতে বিনয়ী ও নম্র হওয়া জরুরি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি সুযোগের সদ্ব্যবহার ও বিনয় না থাকলে আজকের পজিশনে আমি আসতে পারতাম না।

সুসান চ্যাপম্যান বলেন, আমার জীবনের ক্যারিয়ার নির্ধারণকারী মুহূর্তগুলোর একটি হচ্ছে আমি এক্সিকিউটিভ লিডারশিপ কাউন্সিল দ্বারা আয়োজিত প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিতেছিলাম। এই সংস্থাটি কৃষ্ণাঙ্গ বিজনেজ কমিউনিটি উন্নয়নে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিযোগিতার পরবর্তী সময়ে কাউন্সিলের কয়েকজন সিনিয়র সদস্যেদের সঙ্গে দেখা করার জন্যও আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। 

তিনি দেশের সবচেয়ে সফল কৃষ্ণাঙ্গ এক্সিকিউটিভদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন উরসুলা বার্নাস, যিনি পরবর্তী সময়ে জেরক্সের সিইও হয়েছিলেন। আরো ছিলেন কেনেথ চ্যানল্ট, যিনি পরবর্তী সময়ে আমেরিকান এক্সপ্রেসে প্রধান নির্বাহী হয়েছিলেন। চ্যাপম্যান বলেন, আমরা এসব অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলাম  যাদের কাছে যাবার মত আমাদের কোনো পরিচিতি ছিল না। এটি আমাদের তাদের অনেকের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছিল। 

তারা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এবং যখন আমি ক্যারিয়ারের পথে চলা শুরু করি, তখনো তারা পরামর্শদাতা হিসেবে পাশে ছিলেন। সে সময়ের প্রতিযোগিতায় বিজয়ীরা এবং বড় বড় মহারথীরা একে অপরের সঙ্গে এখনো সংযুক্ত আছি। আমাদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী কৃষ্ণাঙ্গদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, যা ক্যালিবার নামে পরিচিত।

চ্যাপম্যান বলেন, আমাদের এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা শুধু আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গেই পরামর্শ দাতা কিংবা গ্রহীতার সম্পর্ক রাখতে পারে বিষয়টি তেমন নয়। তারা চাইলে যে কারো সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। তবে আমি বলবো কৃষ্ণাঙ্গদের পরামর্শ বাকি সদস্যদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। কারণ, আপনি জীবনে যে পথে হাঁটতে চাচ্ছেন, সেই পথের পরামর্শদাতা হিসেবে তিনিই শ্রেষ্ঠ, যিনি এই পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন।

ঢাকা/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়