যেভাবে কমবে যৌন নিপীড়ন
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম
প্রতিবছর ৪ মার্চ বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস পালন করা হয়। যদিও দিবসটি নিয়ে আমাদের দেশে তেমন প্রচার প্রচারণা নেই। যৌন বিষয়গুলো আমাদের দেশে এখনো এক প্রকার ট্যাবু হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। এতে আমাদের সমাজে যৌন বিষয়ক পজেটিভ কোনো অভিজ্ঞতা অনেকেরই নেই।
যৌন নিপীড়ন কী?
যৌন হয়রানি এবং শরীরের অবাঞ্ছিত স্থানে অনধিকার চর্চা, সেইসঙ্গে অননুমোদিত যৌন কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করাকেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন। সহজ কথায় কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন কার্যকলাপ বা যৌন জিঘাংসা বাস্তবায়নের অভিপ্রায়কেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন।
আক্রান্ত হয় কারা?
নারী বা পুরুষ যেকেউ যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী, কন্যা শিশু এবং ছেলে শিশুরাই অধিকমাত্রায় আক্রান্ত হয়। আবার অনেক সময় বৃদ্ধরাও শিকার হতে পারেন।
কীভাবে আক্রান্ত হয়?
কন্যা এবং ছেলে শিশুরা খুব সহজেই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ছোট হওয়ার কারণে তারা সহজে যৌন উৎপীড়ককে বাঁধা দিতে পারে না। তাই ছোট ছোট শিশুরা তাদের আশেপাশের আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজনদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিগৃহীত হয়। আমাদের পরিবারে এমন কিছু সদস্য থাকে, যাদের কখনোই আমাদের সন্তানদের জন্য ক্ষতিকর মনে করি না। কিন্তু এইসব আত্মীয়স্বজন দ্বারা শিশুরা বেশি নির্যাতিত হয়। অনেক সময় শিশুরা এদের বিরুদ্ধে কিছু বললেও অনভিজ্ঞতার কারণে আমরা তাদের কথা এড়িয়ে যাই।
ছেলে শিশুরা এভাবে আক্রান্ত হলেও আমাদের সমাজে ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ আক্রান্ত হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিশুদের সঙ্গে নারীদেরও একটি বৃহৎ অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। বিশেষ করে যেসব নারীর নিজস্ব প্রকৃত স্বাধীনতা নেই, যারা কোনো না কোনোভাবে অন্যের ইচ্ছার অধীনস্থ তারাই বেশি আক্রান্ত হয়। সেইসঙ্গে নারীদের কর্মস্থলেও দুর্বলতার সুযোগে একটি অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
শুধু তাই নয়, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও উচ্চ শ্রেণীর নারীরাও যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কারণেও কিশোরী, নারী ও শিশুরাও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে যেকোনো দুর্বলতা নিয়ে নারীদের ব্ল্যাকমেইলের কারণেও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফাঁদে ফেলে যৌন নিপীড়ন করা হয় নারীদের।
কাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়?
আমাদের পরিবারকে ঘিরে কিছু সদস্য থাকে, যারা বিকৃত চরিত্রের অধিকারী। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থেকে ছোট ছোট শিশুদের টার্গেট করেন। তাদের বিকৃত রুচির অভিলাষ পূরণ করেন। এইসব আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজন শিশুদের প্রলোভন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক যৌন নিপীড়ন করেন।
পরিবারে কিছু সদস্য থাকেন, যাদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক। এইসব ভগ্নিপতি (দুলাভাই) বা দাদা সম্পর্কীয় সদস্যরাও অনেকক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন করার সুযোগ নেন। যা আমরা হাসি-তামাশার ছলে এড়িয়ে যাই। সেইসঙ্গে আদর-স্নেহ দেবার ছলেও অনেক চাচা, জ্যাঠা, মামা, খালু, ফুফা ইত্যাদি থাকে। যারা আদর করার নামে কৌশলে শিশুদের নিজের যৌন লিপ্সা পূরণে ব্যবহার করেন।
ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ শিক্ষক দ্বারা এবং আশেপাশের মধ্যবয়স্কদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ছেলেরাও যে যৌন হয়রানির শিকার হয়, তা আমরা অনেকেই জানি না। দুর্বল নারীরা ঘরে এবং কর্মক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দ্বারা আক্রান্ত হন। প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় গণপরিবহনেও নারী ও শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। মেয়েরা স্কুল কলেজে আশেপাশের বখাটের দ্বারা নিগৃহীত হয়। সামাজিক মাধ্যমে কিছু কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তি দ্বারাও নারী ও শিশুরা ভার্চুয়াল যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সেইসঙ্গে মিডিয়াতে কাজ করতে আসা উঠতি মডেল বা তারকারাও তাদেরই পেশাজীবীদের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
নিপীড়ন থেকে বাঁচার উপায়
যৌন নিপীড়ন থেকে শিশু ও নারীদের বাঁচাতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
সচেতনতা
শিশুদের যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই যেটা জরুরি, সেটা হচ্ছে সচেতনতা। প্রতিটি পরিবারকে শিশুদের যৌন বিষয়ক নিরাপত্তার শিক্ষা দিতে হবে। যাতে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হলে তা পরিবারকে জানাতে পারে। এই বিষয়ে জ্ঞান না থাকার কারণে অনেকেই বুঝতেই পারে না তাদের যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে। সুতরাং পরিবারের প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে শিশুদের যৌন বিষয়ে সচেতন করা।
শিশুর আচরণ লক্ষ করা
আমাদের অভিভাবকদের যৌন বিষয়ক বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে শিশু এবং নারীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাই অভিভাবকদের উচিত এই বিষয়ে ব্যাপকভাবে চিন্তা করা। পরিবারের শিশুদের আচার আচরণের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা লক্ষ রাখা। পরিবারের আশেপাশের সদস্যরা কে-কেমন রুচির অধিকারী তা জানার চেষ্টা করা। শিশুদের কারো প্রতি কোনো অভিযোগ থাকলে তা আগ্রহ নিয়ে শোনা এবং পদক্ষেপ নেওয়া।
শিশুদের একা ছেড়ে না দেওয়া
কোনো শিশুকেই কারো সঙ্গে একাকি যেতে না দেওয়া বা ঘরে কখনোই শিশুদের একা না রাখা। শিশুরা কারো সঙ্গে একাকি সময় দিচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখা। স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রতি শিশুদের অনীহা সৃষ্টি হলে তার কারণ অনুসন্ধান করা। সেইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা কোনো প্রকার নির্যাতনের শিকার বা তাদের কোনো প্রকার বুলিং করা হচ্ছে কিনা তা জানার চেষ্টা করা।
স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী হওয়া
নারীদের স্বাবলম্বী এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সহায়সম্বলহীন নারীদেরই বেশিরভাগ সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে দুর্বল নারীদের আশেপাশের যৌন পিপাসু মানুষেরা অতিমাত্রায় নির্যাতন করার সুযোগ নেয়। সেইসঙ্গে সংসারে দুর্বল হওয়ার কারণে অনেক স্ত্রীকেও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
নারীরা যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে তারা যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে। যারা যৌন নির্যাতন করে, তাদের চোখে চোখ রেখে এর প্রতিবাদ করতে জানতে হবে। এই আত্মবিশ্বাসটা শিশুরা পরিবার থেকেই অর্জন করে। তাই পরিবারের উচিত শিশুদের আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী হতে সাহায্য করা। যাতে তাদের সঙ্গে কেউ অন্যায় কিছু করতে চাইলে তারা যেন এর প্রতিবাদ করতে এবং সবাইকে জানাতে পারে।
বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের সঙ্গে অভিভাবকদের সুন্দর, সাবলীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করা উচিত। যাতে তারা স্কুল কলেজে তার সঙ্গে কে কী করছে তা সহজে জানা যায়। পারিবারিক সম্পর্কগুলো স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে অসংখ্য কিশোর, কিশোরী এবং মেয়েরা তাদের সঙ্গে হওয়া নিপীড়নের কথা পরিবারকে জানাতে পারে না। ফলে এইসব কোমলমতি শিশু, কিশোর, কিশোরীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে এক ধরনের মানসিক অবসাদগ্রস্ততে ভোগে। যা পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগে এবং আত্মহত্যায় পরিণত হয়।
ভার্চুয়াল জগৎ থেকে দূরে রাখা
কিশোর-কিশোরীদের কখনোই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স না হওয়ার আগ পর্যন্ত ভার্চুয়াল জগৎ থেকে কিশোর কিশোরীদের দূরে রাখতে পারলে যৌন নিপীড়ন থেকে অনেকাংশে দূরে রাখা যাবে। যেসব ছেলেরা যৌন নিপীড়ন করে, তারা অবাধ ইন্টারনেট থেকে যৌন আসক্তি অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে তারাই যৌন নিপীড়ন শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই ভার্চুয়াল জগতে ব্ল্যাকমেইল করেও যৌন নিপীড়ন করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা সৃষ্টি
যৌন নিপীড়ন থেকে শিশুদের বাঁচাতে হলে স্কুল কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সেইসঙ্গে সামাজিক বেড়াজাল ছিন্ন করে সবাইকে খোলামেলাভাবে এইসব নিয়ে জানাতে হবে। যাতে শিশুরা নিজেদের সমস্যার কথা নিজেরাই বলতে পারে এবং কখনো নিপীড়িত হলে তার প্রতিবাদ করতে পারে।
হেয় প্রতিপন্ন না করা
অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, যারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, তাদের পরবর্তী সময়ে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। যা কখনোই উচিত নয়। যৌন নিপীড়নের শিকার কিছু কিছু সাহসী ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের পরিবার থেকে থামিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে তাদের সামাজিকভাবে কটুদৃষ্টিতে দেখা হয়। যা অন্যজনকে সাহসী হতে বাঁধা দেয়। তাই কারো সঙ্গে কোনো প্রকার যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে তা যেন আমরা নেতিবাচকভাবে না নেই। আমরা যেন যৌন নিপীড়িত ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি সহমর্মীতার হাত বাড়িয়ে দেই। যাতে সমাজে আর কেউ এইজাতীয় কুকর্ম করার সাহস না করে।
যৌন নিপীড়নের ক্ষতিকর দিক
যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে অনেক শিশু এবং নারীরা পরবর্তী জীবনে মানসিক অসুস্থতায় ভোগে। যারা ছোট বয়সে যৌন নিপীড়িত হয়, তারা নিজেদের সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারে না। ছেলে শিশুরা যৌন নিপীড়িত হলে পরবর্তী জীবনে তারাও এক ধরনের যৌন নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বারবার যৌন নিপীড়নের সুযোগ নিয়ে পরবর্তী সময়ে ওইসব নিপীড়করা সাহস পেয়ে ধর্ষণের মতো চরম জঘন্য কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ হয়। আজকে সমাজের চারদিকে যৌন নিপীড়ন এমনভাবে বেড়ে গেছে যে, দুই বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এর মূলে রয়েছে সমাজের মানুষের অনীহা। তারা এইসব নিয়ে সহজে কথা বলে না। যদি সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে এর বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতো তাহলে যৌন নিপীড়করা সহজে অপকর্ম করার সাহস পেতো না।
শুধু তাই নয়, যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কারণে অনেক ভুক্তভোগী পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। সমাজে যে হারে আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে গেছে, তার মূলে অনেকাংশে কাজ করে যৌন নিপীড়নের ঘটনা। অনেকে নিজ থেকে সুস্থ হতে চাইলেও আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের লাঞ্চনার শিকার হয়ে অনেকেই সুস্থতার পথ খুঁজে পায় না। ফলে অনেক কোমলমতি শিশুর জীবন শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। এইসব শিশুরা এবং নারীরা পরবর্তী জীবনে মানসিকভাবে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে না।
সচেতনতাই শেষ কথা
সর্বোপরি কথা হচ্ছে, সমাজ থেকে যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা নির্মূল করতে হলে অবশ্যই সবচেয়ে বেশি জরুরি সচেতনতা। আমরা পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারবো, তত বেশি যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা থেকে মুক্তি পাবো। সঠিক ধর্মীয় অনুশাসনও যৌন নিপীড়ন থেকে সমাজকে পবিত্র রাখে। আসুন প্রত্যেকে নিজ নিজ অঙ্গন থেকে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
লেখক: কলাম লেখক।
ঢাকা/মাহি
আরো পড়ুন