ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিল্পীর রঙ-তুলিতে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু 

মুমতা হেনা মীম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৭, ২২ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৪:১২, ২২ মার্চ ২০২১
শিল্পীর রঙ-তুলিতে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু 

মানুষ সুন্দরের পূজারী। প্রকৃতির সৌন্দর্য যেমন সবার মনকে আকর্ষণ করে, তেমনি শিল্পীর সৃজনশীল রঙ-তুলির আঁচড়ও মানুষকে আকৃষ্ট করে। 

যুগে যুগে শিল্পীরা প্রকৃতি-পরিবেশ-কাল্পনিকচিত্র তাদের ক্যানভাসে নিজস্ব ভাবধারায় ফুটিয়ে তুলেছেন। অনেকে ইতিহাসকেও ফুটিয়ে তোলেন তুলির আঁচড়ে, ইতিহাসের চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে শিল্পীর শিল্প অনন্য এক ভূমিকা রাখে। 

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এদেশের শিল্প-সাহিত্যের এক অফুরন্ত প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমাদের শিল্পের ভূবনে অনেকেই কাজ করছেন, রচিত হয়েছে অনেক কালজয়ী শিল্প। যারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন শিল্পী সঞ্জীব দাস অপু। তুলির আঁচড়ে ক্যানভাস রাঙান নিজস্ব ভাবধারায়। তার আঁকা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছবির মধ্য থেকে কয়েকটি নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করলেই শিল্পীর মানসলোকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কতটা প্রতিষ্ঠিত, তা উপলব্ধ হবে।

মুক্তির মহানায়ক

এচিত্র কর্মটি ৩০’×৩৬’ ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রেলিক রঙয়ের ব্যবহারে আঁকা হয়েছে। চিত্রশিল্পী তার তুলির আঁচড়ে হিমালয়ের ন্যায় লক্ষ্যে অবিচল, প্রত্যয়ী  সাহসী নেতার প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন। দু’ চোখে তার স্বাধীনতার স্বপ্ন।  দূরে, বহুদূরে আকাশ ছোঁয়া তাঁর দূরদর্শী দৃষ্টি। শিল্পীর নিয়ন্ত্রিত রঙের ব্যবহারে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত প্রতিকৃতি।

আদমজী জুট মিলের দাঙ্গা কবলিত এলাকায় বঙ্গবন্ধু

অ্যাক্রেলিক রংয়ে  ৩৬” × ৩৬” ক্যনভাসে আঁকা হয়েছে। ১৯৫৪ সালের দাঙ্গার সময়ে আদমজীর শ্রমিকরা তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে পাশে পেয়েছিলেন। শেখ মুজিব প্রথম মন্ত্রী হন ১৯৫৪ সালের ১৫ মে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের সময় তারা জানতে পারেন আদমজীতে বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে ভীষণ দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। এসময় শেখ মুজিব শান্তির দূত হয়ে আদমজী জুট মিলে ছুটে যান। 

দাঙ্গায় আহতদের সেবা শুশ্রূষা করেন এবং হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেন। পরদিনও বঙ্গবন্ধু আদমজী জুট মিলে গিয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের পাশে দাঁড়ান। ছাত্রাবস্থা থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ান। শিল্পী তার নিপুণ চিত্রকর্মের মাধ্যমে এ বিষয়টিই ফুটিয়ে তুলেছেন।

বঙ্গবন্ধু লিখলেন এক অমর কবিতা

১৯৯৩ সালে ৬০”×৫৭” কাগজে জল রঙে ছবিটি এঁকেছিলেন শিল্পী। লালচে-বাদামী পটভূমিতে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই সোনালী বিকেলের গল্প।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এ দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত হন। অনন্য উদ্দীপনা নিয়ে তাকিয়ে ছিল সবাই, কী বলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু শোনান এক অমর কবিতা- ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম!’ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য এ ছিল অন্তিম মুহূর্ত। অন্যদিকে স্বাধীনতার চেতনায় প্রদীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য এ ভাষণ ছিল শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা। বঙ্গবন্ধু তার তর্জনীর ইশারায়ই যেন এঁকে গিয়েছিলেন এ বাংলার মানচিত্র।

বার্থ অব এ ন্যাশন 

৪'×৫' ক্যানভাসের এই চিত্রকর্মটি ২০০০ সালে আঁকা। তেল রঙের ব্যবহারে, বিভিন্ন মোটিফ, ফর্ম ও টেকচার ব্যবহার করে ছবিতে তিনি যে দৃশ্যকল্প তৈরি করেছেন তাতে ফুটে উঠেছে ১৯৭১ এর সেই অগ্নিগর্ভ সময়। ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে, মৃত্যুর নদী থেকে জন্ম নিচ্ছে একটি নতুন দেশ। বাঙালি জাতির আকাঙ্ক্ষিত নতুন সুর্যকে ছিনিয়ে আনতে যারা যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন, তাঁদের প্রতীক রূপে উলম্ফমান এক যোদ্ধাকে দেখা যাচ্ছে। ছবির ডান দিকে উপরের সারিতে কিছু সৈনিকের অস্পষ্ট অবয়ব। শিল্পী ছবির পুরো আবহজুড়ে সেই সময়ের ইমেজ তৈরি করেছেন।

ছবিগুলো একসঙ্গে দেওয়া হলো

’৭১: আনন্দ বেদনার কাব্য

৪’×৫’ তৈলচিত্রটি ১৯৯৭ সালে আঁকা। শিল্পী তার চিত্রে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়টাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে যেমন প্রিয়জন হারানোর শোক, মৃত্যু, ধ্বংস নিয়ে এসেছিল, তেমনি যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে বাঙালি পেয়েছে আজন্ম প্রত্যাশিত স্বাধীন রাষ্ট্র। এটা আনন্দের। উপরের চিত্রে নীল বা সমুদ্রনীল এসেছে বেদনার রঙ হিসেবে, অন্যদিকে উদিত সূর্যের আকাশে যে হলুদাভ লালচে রঙ থাকে, ছবিতে তা এসেছে আনন্দের রঙ হিসেবে। স্বাধীনতার সূর্য উঠার লগ্ন। এখানে ২৫ মার্চ গণহত্যার সময় রিকশায় পড়ে থাকা লাশের আবহ আছে। আবার প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রতীক হিসেবে কতগুলো সরল ও সবল রেখার একতাবদ্ধ অবস্থান আছে। শিল্পী তার এ চিত্রে এক ধরনের মায়া সৃষ্টি করেছেন, যা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনুধাবন করা যায়।

তোমার হাতের মুঠোয় ছিল সূর্যস্ফটিক

৩৬"×৩৬" চিত্রকর্মটি ড্রাইব্রাশ টেকনিকে অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। পিতা পড়ে আছে বিশাল ধ্বংসস্তুপের মতো। তার হাতে ধরা প্রিয় টোব্যাকো পাইপ। পাইপের আড়ালে সূর্যস্ফটিক। দুমড়ে-মুচড়ে গেছে সব, মেঝে রক্তে রঞ্জিত তবু আলোকিত বঙ্গবন্ধু! চিত্রে দেখা যাচ্ছে ফুলের আড়ালে ধারালো অস্ত্র, তার দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে, বিশ্বস্তদের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল পৈশাচিক ঘাতক। 

শিল্পী তার চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ঘাতকেরা জাতির পিতাকে হত্যা করলেও মুছে ফেলতে পারেনি তার চেতনাকে। বঙ্গবন্ধুর হাতে যে সূর্যস্ফটিক দেখা যাচ্ছে, তা তিনি বহু আগেই তার তর্জনীর ইশারায় স্থাপন করেছিলেন এদেশের মানুষের হৃদয়ে। এ চিত্রে হলদে-লালাভ রঙের ব্যবহার এবং দেয়ালের আলো-ছায়া শিল্পী দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। চিত্রকর্মটি ৩২ নম্বরের সেই ভয়াল সময়টাকে তুলে ধরেছে।

শিল্পকর্মের সমালোচনার অধিকার দর্শকের রয়েছে, দর্শকের অভিমত, অনুপ্রেরণাই শিল্পীর পরবর্তী সৃষ্টিকে আরো নন্দিত করে তোলে। শিল্পী তার সৃষ্টির মাধ্যমেই দর্শক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেন। হৃদয়কে আন্দোলিত করেন এবং মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেন আর এখানেই শিল্পীর স্বার্থকতা। 
আজ আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহঙ্কার, স্বাধীনতা আমাদের পরম প্রাপ্তি। সেই মুক্তিযুদ্ধ যার নেতৃত্বে হয়েছিল, এই স্বাধীনতা যার হাত ধরে এসেছিল তিনি বঙ্গবন্ধু। আমরা ইতিহাসের এমন এক সময়কে অতিক্রম করছি, যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সঙ্গে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। যে কোন জাতিগোষ্ঠীর আবেগ-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে, তাদের শিল্প-সাহিত্যে। 

বঙ্গবন্ধু এমন এক নেতা ছিলেন, যিনি জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতেন। আজকে স্বাধীনতার ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এ কথাও নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এ দেশের মানুষও তাদের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরাও তাকে তুলে ধরেন তাদের অনুভবের আলোয়। সে আলোয় আলোকিত হয় শিল্পের ভূবন, প্রদীপ্ত হয় আমাদের চেতনার শিখা।

লেখক: চিত্র সমালোচক ও শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। 

রাবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়