ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

তরুণদের চোখে ৫০ বছরের বাংলাদেশ 

সানজিদা ইয়াসমিন লিজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪১, ২৪ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৪:৫৪, ২৪ মার্চ ২০২১
তরুণদের চোখে ৫০ বছরের বাংলাদেশ 

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হওয়ার পেছনে রয়েছে এক সাগর রক্তের ইতিহাস। স্বাধীনতা শব্দটি অর্জন করতে আমাদের দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই অর্জনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি চরম দাসত্ব, নিপীড়ন ও অত্যাচার থেকে যেমন দেশের মানুষকে মুক্ত করেছে, তেমনি সাহসী সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে একটা উজ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। 

আমরা স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে পৌঁছেছি ঠিকই কিন্তু স্বাধীন দেশ হিসেবে সূবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের প্রত্যাশা ও অর্জন কতটুকু? এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের মতামত ও ভাবনা তুলে ধরেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সানজিদা ইয়াসমিন লিজা। 

জুবায়ের আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা উত্তাল মার্চ মাসে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে সব শ্রেণিপেশার মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। 

শুরুতে দুর্বল অর্থনীতি, যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো, অধিক জনসংখ্যা ও নিন্ম শিক্ষার হার থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাঙালি অর্জন করছে আকাশ-ছোঁয়া সাফল্য। উন্নয়নের অগ্রযাত্রার ৫০ বছরে আমরা প্রমাণ করেছি আমরা শুধু দেশ স্বাধীন করিনি বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আমাদের যারা হেয় করতো এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র বলতে চাইত তাদেরও ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির বিচ্যুতি থাকলেও বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নের্তৃত্বে শিগগিরই তা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবেন আমরা এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করি।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী হাসনাত আহমদ। তিনি বলেন, কিছু দিন পরেই বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ উদযাপন করবে তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতা লাভের অর্ধশত বছর পেরিয়ে এসে আমরা পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাবো আমাদের প্রত্যাশার কতটুকু অর্জিত হয়েছে। 

আমাদের পরে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। অপ্রাপ্তি হিসেব করলে তা দীর্ঘায়িত হবে ঠিকই কিন্তু আমরা কতটুকু অর্জন করেছি, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। 

আমাদের দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো আমাদের জনসংখ্যা। ভৌগলিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে আমাদের আয়তনের চেয়ে জনসংখ্যা অনেক গুণ বেশি। কিন্তু এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রুপান্তর করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা, বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং কর্মসংস্থান তৈরি করে কাজের সুযোগ করে দেওয়া। পাশাপাশি শ্রমিকদের শ্রম যেন যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে মজুরি নির্ধারণ করা হয়, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) রিপোর্ট অনুযায়ী এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার বেলায় বাংলাদেশ সবার পেছনে। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দারিদ্র্যসীমার নিচে। যদিও দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই।

আমাদের দেশকে কৃষিনির্ভর দেশ বলা হয়ে থাকে। কৃষিনির্ভর দেশের একজন কৃষক তার ফসলের দাম ঠিকঠাক মতো পায় না অনেক সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়লে তা চোখে পড়ে। কৃষকদের পর্যাপ্ত অনুদান দিতে হবে এবং বন্যা, খরা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঘাটতি পুষিয়ে তাদের পেশায় স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

তারপর আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের শিক্ষা খাত। শিক্ষা খাতের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে স্বাক্ষরতার হার বাড়ছে। শিক্ষার গুণগত মান কতটুকু বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়। তাই শিক্ষার গুণগত মান বজায় রেখে স্বাক্ষরতা নিশ্চিত করতে হবে।

ফাহিম আহমেদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী কাটিয়ে দিলাম। সবাই যার যার ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ হাসিলে মত্ত। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে দেশমাতৃকা আমরা পেয়েছি, তার মর্যাদা আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি? 

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল আহাদ। তিনি বলেন, আজ আমরা যে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক সেই স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের কাছে এমনি এমনি আসেনি। হাজারো অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে এদেশের মানুষকে। এরপর পেয়েছি স্বাধীন একটি ভূখণ্ড, পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা।

দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় এভাবে স্বাধীনতারও ৫০টি বছর আমাদের কাছে উপস্থিত। এই সূবর্ণজয়ন্তীতে আমরা এমন একটি দেশ প্রত্যাশা করি, যেখানে প্রত্যেকটি নাগরিক পাবে তাদের মৌলিক অধিকার।
এমন একটি দেশ চাই, যেখানে থাকবে না কোনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, থাকবে না চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী, যেখানে বিরাজ করবে না সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যেখানে পত্রিকার পাতা খুললে প্রথমেই চোখে পড়বে না ধর্ষণের মতো জঘন্য ও সামাজিক গর্হিত কাজ।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশের প্রত্যেকটি মানুষ জাতি ধর্ম, বর্ণ ভুলে গিয়ে শুধু বাঙালি পরিচয়ে একে-অন্যের হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল, ঠিক তেমনি জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তে যেন তাদের বন্ধন থাকে অটুট। 

এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ একটু ধীর গতিতে হলেও অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত দিকসহ সব ক্ষেত্রেই দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, পদ্মা সেতু নির্মাণ, আইটি ক্ষেত্রে অচিন্তনীয় সাফল্য অর্জন তার একেকটি মাইলফলক। 

আব্দুল করিম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উদযাপন বাঙালির বীরত্ব আর আত্মত্যাগের এক উজ্বল প্রতীক ও নিজস্ব সত্তার এক গৌরবময় ইতিহাস। বাঙালি রুখে দাঁড়াতে জানে, লড়াই করতে জানে, হারতে শেখেনি, হারাতে শিখেছে, যার প্রমাণ গোটা বিশ্ব দেখেছে। 

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন করার আগ পর্যন্ত বাঙালি ছিল দুর্বার, দুর্দমনীয়। কিন্তু পরাধীনতার চরম গ্লানি প্রতিহত করার পরেও দেশ কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এসে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এখনো অনেক অসহায়, দুস্থ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত। 

আব্দুর রহমান রুহিন, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস। বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গবেষণা প্রতিটি খাতে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে। 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও অর্থনৈতিক সাম্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি এবং নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অনেক বাধা ও বিলম্ব হচ্ছে। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তবে বিগত এক দশক ধরে দেশজুড়ে যে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে, তা আমাদের মনে আশার আলো জ্বালাচ্ছে।

কুবি/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়