ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

সন্তানের জীবনের সিদ্ধান্ত সন্তানকেই নিতে দিন  

তমাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ৩০ মার্চ ২০২১  
সন্তানের জীবনের সিদ্ধান্ত সন্তানকেই নিতে দিন  

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমার দেখা সিংহ ভাগ পরিবার স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে থাকে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল বা মফস্বলের প্রায় সব পরিবারের মধ্যেই এই স্বৈরাচারী ভাব বিদ্যমান। মানুষের ভালো লাগা, মন্দ লাগার ব্যাপারগুলোতে জেনেটিক্যাল প্রভাব খুবই কম থাকে। কারো লেখালেখি ভালো লাগে, আর কারো ছবি আঁকা ভালো লাগে। এসব বিষয়ে জিনগত প্রভাব একেবারেই কম থাকে।

কিন্তু পারিবারিকভাবে আমাদের উপর সেই বিষয়গুলো জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়তই। আমার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু পরিবার চায় আমি ডাক্তার হবো। পরিবারের এই চাওয়াটাই সন্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। স্বৈরাচারী মনোভাবের সূচনা এখান থেকেই শুরু, অপর দিকে হয় গণতন্ত্রের মৃত্যু। অথচ রাষ্ট্রের থেকে পরিবারেরই হওয়া উচিত ছিল গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর। যেখানে ছোট থেকে বৃদ্ধ সবার মতামত প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এমনটা হচ্ছে না। অভিভাবকদের স্বৈরাচারী মনোভাব সন্তানের ভবিষ্যৎ মসৃণ হতে দেয় না।

স্বাভাবিকভাবেই আমরা আমাদের সন্তানদের প্রচুর ভালোবাসি। আর সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ চাপিয়ে দেই তাদের উপর। নিজেদের একটা প্রতিচ্ছবি দেখার চেষ্টা করি সন্তানের ভেতর দিয়ে। ব্যক্তিগত ভালো লাগা, রুচিবোধ ইত্যাদি সবসময় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাই। শৈশবের খেলাধুলা করা থেকে যৌবনের বিয়ে পর্যন্ত আমরা এই স্বৈরাচারী মনোভাব ধরে রাখি। যদি সন্তানেরা মেনে নেয়, তাহলে আমরা খুশি। কেউ মানতে না চাইলেই বেয়াদব বলে স্বীকৃতি দিয়ে দেই।

সন্তানের ব্যাপারে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আবার আমাদের যুক্তি সবসময় খাড়া। ছোট বয়সে বাচ্চারা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবে। তাদের এসব করতে দেওয়া যাবে না। ওরা বয়সে এখনো ছোট। এই জাতীয় কথা বলে আমরা একটা বাড়ন্ত প্রজন্মের পায়ে শিকল পরিয়ে দেই। একটা বাচ্চাকে যদি শিশুকাল থেকেই ভাবতে না শেখাই, তার ভেতরে যদি বড় হওয়ার ভয় ঢুকিয়ে দেই শৈশব থেকেই, তাহলে এই প্রজন্ম থেকে অদূর ভবিষ্যতে কতটুকু ফিডব্যাক আশা করা উচিত আমাদের? আর কতটুকুই বা করছি?

আমরা সবাই সুপারি গাছ লাগিয়ে নারিকেলের আশা করি। সেটা যে অসম্ভব ব্যাপার তা নয়, অবাস্তবও বটে। পারিবারিক গণতন্ত্র যতটা মসৃণ হবে, ততটাই ভালো ফলাফল আমরা পাবো সামাজিক জীবনে, এতে সন্দেহ নেই। একটা রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ শাসন ব্যবস্থার ছোট্ট একটা ক্ষেত্র পরিবার। মুক্ত চিন্তা ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে হলে পারিবারিক স্বৈরাচারী মনোভাব থেকে বের হয়ে আসার বিকল্প নেই।

সন্তানদের নিজের সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত। হ্যাঁ ভুল করবে, মানুষ মাত্রই ভুল। আমরা তাদের ভুলটা ধরিয়ে দেব। কিন্তু তার চলার পথের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারি না। সংকটপূর্ণ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গেলে নিজের ব্যাপারে সঠিক এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারার বিষয়টা সবসময় এগিয়ে থাকে।

সব থেকে বড় ভুলটা করি যখন আমরা সন্তানের ক্যারিয়ার বিষয়ক দিকটা নিজেরাই ভেবে দেই। অভিভাবকেরা আগে থেকেই নিজের সন্তানের সৃজনশীলতায় শিকল পরিয়ে রেখেছেন। তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগটা দেই না। অপর দিকে বাবা মায়ের স্বপ্নটাও ভাবতে হয়। এই বিষয়টা সবচাইতে বেশি জটিলতা সৃষ্টি করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। একটা বয়সে এসে অধিকাংশ তরুণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।

পরিবার থেকেই আমাদের বাক স্বাধীনতার পাশাপাশি ব্যক্তি স্বাধীনতাও হরণ করা হয়। সন্তানেরা পিতা মাতার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যদি একটাও সিদ্ধান্ত নেয় আর সেটা যদি ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলেই আমরা উঠেপড়ে লেগে যাই তার ভুল ধরে সমালোচনার বুলি শোনাতে। কিন্তু একটা ভুল থেকেই শিক্ষা হয়। ভুল সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই একটা সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সন্তানেরা উপযুক্ত হয়। কিন্তু আমরা সবসময় ভুলটাকেই বড় করে দেখি। ভুলের থেকেও প্রাপ্তি আছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ও করি না আমরা।

সব চেয়ে বড় অধিকার হরণতো করা হয় বিয়ের সময়। একটা ছেলে বা মেয়ে বাকি জীবন একজনের সঙ্গে কাটাবে। সেই ব্যাপারেও নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নিজের সন্তানকে আমরা অনুগত দাস হিসেবে বড় করে তুলি। একটা সিদ্ধান্ত নেব কি, মতামত পর্যন্ত দেওয়ার সুযোগ রাখা হয় না।

অভিভাবকের অবশ্যই অধিকার আছে সন্তানের জন্য সেরা অপশন রাখার। কিন্তু সেটাও ভাবতে হবে নিজের কাছে যেটা সেরা, সন্তানের কাছে সেটা কতটুক গ্রহণযোগ্য। সেই বিষয়টা কতটুকুই বা সন্তানেরা ধারণ করতে পারবে। গণতান্ত্রিক মনোভাবটা পরিবার থেকেই গড়ে ওঠে। একটা পরিবারে যখন সবার মতামত, রুচিবোধ এবং সৃজনশীলতাকে সমান মূল্যায়ন করে, তখন সেই পরিবারের মননশীলতা, চিন্তা ধারার মধ্যে বিশাল পরিবর্তন আসে। সেই সন্তান তখন আশেপাশের মানুষের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। গঠনমূলক সমালোচনা নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এই দৃশ্য চোখে পড়ে না। 

আজ আমরা একজন মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেই না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এর নেতিবাচক ফলাফল বেশ লক্ষ্যণীয়। কারো কাজ ভালো না লাগলে তাকে গঠনমূলক সমালোচনা না করে বুলিং করি আমরা। স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না। 

স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের অন্যের মতামত, আচরণ এবং কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। একজন একটা ব্যাপারে ভুল হতেই পারেন। তাকে সেই ভুলের জন্য কড়া সমালোচনা না করে গঠনমূলক সমালোচনা করাই উপযুক্ত।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়