ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

আমার পহেলা বৈশাখ  

শান্তা ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩১, ১৫ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৪:৪৭, ১৫ এপ্রিল ২০২১
আমার পহেলা বৈশাখ  

প্রবাস জীবন দূর থেকে দেখতে যতটা না আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর মনে হয়, ঠিক ততটাই খারাপ লাগা এবং একাকিত্ব কাজ করে। এখানে সবকিছুই আছে, শুধু নেই নিজ শেকড়ের সতেজ অনুভূতি, নেই প্রিয়জনদের স্নেহমাখা আদর। তারপরও উচ্চশিক্ষা ও উন্নত জীবনের হাতছানিতে প্রবাস জীবনটা বেছে নেয় অনেকেই। 

২০০২ সাল। নিজের সাজানো ছোট্ট জগতেই মগ্ন থাকতাম। খেলাধুলা, পড়ালেখা ও চারপাশ মাতিয়ে রাখাতেই কেটে যেত আমার সময়গুলো। একদিন জানতে পারলাম, আমরা নিজ দেশ ছেড়ে দক্ষিণ কোরিয়া চলে যাচ্ছি। মনটা খারাপ হলো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করবো। পরিবার-পরিজন ছেড়ে কীভাবে যাবো, এত দূরে মন কীভাবে টিকবে! আরেক দিকে বেশ শিহরণ ও উৎফুল্লও বোধ করছিলাম। ভিন্ন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ। এক কথায় মিশ্র অনুভূতি।   

এখানে আসার পর প্রথম প্রথম তেমন খারাপ লাগা কাজ করেনি। সব কিছু গুছিয়ে উঠতে গিয়ে কোন দিক দিয়ে সময় চলে যেত, বুঝেই উঠতে পারতাম না। আমি আর আমার ভাই পড়ালেখা শুরু করি আর অন্যদিকে বাবা-মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজ নিজ কাজে। তবে সারাদিন তো আর নিজেদের ব্যস্ত রাখা যায় না। ভাবনা ঠিকই আসতো, মিস করতাম নিজ দেশ ও পরিজনদের। ভেবেছিলাম হয়তো  এখানে ২-১ বছর থাকবো। তবে যাওয়ার পর থেকেই জীবনে অনেক কিছুতে পরিবর্তন আসা শুরু হয়। তাছাড়া পারিবারিক কিছু ঝামেলার কারণেও প্রবাসে থাকার সময়টা দীর্ঘ হতে থাকে। আর পড়ালেখা ছেড়ে দেশে ফিরে আসাটাও আমাদের জন্য গভীর ভাবনার বিষয় ছিল। 

প্রবাস থাকার অভিজ্ঞতাগুলো অন্য কোনো সময়ে শেয়ার করবো। আজ জানাবো, এখানে থাকাকালীন সময়ে আমার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের গল্পগুলো। প্রথম দিকে এখানের বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে আমার তেমন পরিচিতি ছিল না। মনে পড়ে, কোরিয়াতে যাওয়ার বেশ কিছু দিন পরের ঘটনা। একদিন বাসায় অনেক অতিথি এলেন। বাবা জানালেন, সবাই তার পরিচিত। বাঙালি দেখে বেশ ভালো লাগা কাজ করলো, তাই সবাইকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করলাম। তারা আমায় খুব স্নেহ করলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কিসে পড়ছি, কোথায় পড়ছি জিজ্ঞেস করলেন। খুব উৎসাহ নিয়ে উত্তরগুলো দিলাম। তারা মূলত এসেছিলেন কোনো এক অনুষ্ঠানের বিষয়ে কথা বলতে। চলে যাওয়ার পর আগ্রহ নিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনারা কারা? কেন এসেছিলেন? বাবা বললেন, আমাদের সবার প্রচেষ্টায় এখানে একটি বাঙালি কমিউনিটি আছে। প্রতি বছরের মতো এবছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছেন তারা, তাই দাওয়াত দিতে এসেছিলেন। আমি শুনে খুবই উচ্ছ্বসিত বোধ করলাম। আনন্দিত ছিলাম এই ভেবে যে, যাক! অনেক দিন পর দেশি মানুষের সঙ্গে এক মিলনমেলা হবে।

অনুষ্ঠানে আমি কি কি করব, কোন ড্রেস পরবো, কীভাবে নিজেকে সাজাবো এসব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরলাম। আমার আগ্রহ দেখে বাবা-মা বেশ খুশি হচ্ছিলেন। দেখতে দেখতে অনুষ্ঠানের দিনও চলে এলো। মনে পড়ে, সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি আম্মুর একটি শাড়ি পড়লাম। ঠিকমতো নিজ থেকে পড়তে পারিনি। তবুও আমার বেশ ভালো লাগছিল। কারণ, শাড়ি আমার খুব পছন্দের। এদিকে আমার স্কুলের দু’জন বান্ধবীকেও দাওয়াত করেছিলাম, সময়মতো তারাও এলেন। শাড়ি পরেছি দেখে তারা দু’জন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, শাড়ি পরবে কিনা। বোধ হয়, সে আমার এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। মুহূর্তেই রাজি হয়ে গেলো। তাকেও আম্মুর একটি শাড়ি পরিয়ে দিলাম, যতটুকু পেরেছি আর কি!   

বান্ধবীদের পাশে পেয়ে ভালো লাগলো। কোরিয়ানরা এমন অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত নয়, আমি যতটা না উচ্ছ্বসিত ছিলাম, তাদের মাঝেও ঠিক সেই পরিমাণ আনন্দ দেখতে পাচ্ছিলাম। সবাই মিলে উপস্থিত হলাম ইভেন্টে। বৈশাখী মেলা চলছিল, বেশ কয়েকটা স্টল দেখতে পেলাম। কেউ বসেছেন চা-কফি নিয়ে কেউবা  চটপটি ও ফুচকার স্টল নিয়ে। তবে মেলার মূল আকর্ষণ ছিল বৈশাখের মূলখাবার পান্তা-ইলিশ। 

অতিথিদের সবাই পান্তা-ইলিশ খাচ্ছিলেন, তাই স্টলটাতে বেশ ভিড় ছিল। আমরাও বেশ তৃপ্তি নিয়ে পান্তা-ইলিশ খেলাম। আম্মু আমাদের পাত্রের মাছের কাটাগুলো সরিয়ে দিচ্ছিলেন। আমার কোরিয়ান বান্ধবীরা একে-অপরের দিকে তাকাচ্ছিল একটু পর পর, আমার বেশ মজা লাগছিল দেখে। আবহাওয়া সেদিন অনুকূলে ছিল না, হালকা ঝড় হচ্ছিল। বাতাসের কারণে শাড়ি ঠিকমতো সামলাতে পারছিলাম না। আম্মু আমায় দেখে হাসছিল আর শাড়ি ঠিক করে দিলেন। মেলায় খেলাধুলার আয়োজনও ছিল। সুই-সুতা, হাঁড়ি ভাঙা, মোরগ লড়াই আরও কত কিছু! এখানে এমনসব খেলার আয়োজন দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। 

লেখক: শান্তা ইসলাম

আমাদের এলাকাতে বাংলাদেশি, ভারতীয়, নেপালি, শ্রীলংকান, ফিলিপিনো ও আফ্রিকান সবাই মিলে অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। এভাবেই প্রতি বছর বৈশাখ পালন করতাম আমরা। দিন দিন আমাদের স্কিল বাড়ছিল, আরও বেশি আপডেট হচ্ছিলাম। প্রোগ্রামগুলোতে নতুন নতুন আয়োজন যোগ হতে থাকলো। বিদেশের মাটিতে বছরে ঈদ ও বৈশাখীটাই মনে হয় বেশ বড় করে পালন করা হতো। তাই সাড়া বছর এই দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকতাম। একটা সময়ের পর থেকে, আনন্দের ভাগিদার হতে অন্য শহরগুলোর অনুষ্ঠানেও যাওয়া শুরু করলাম। 

সময় বেশ ভালো কাটছিল। আমরা স্পন্সর পাচ্ছিলাম, প্রোগ্রামগুলো আরও বেশ বড় পরিসরে হওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই আয়োজক দুই-তিনজন আঙ্কেল দেশে ফিরে এলেন। বাকিরাও ধীরে ধীরে চলে আসতে শুরু করলো। তাই অনুষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায় যায় অবস্থা। আমার এত খারাপ বোধ হচ্ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না, রীতিমতো কান্না পাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। বৈশাখী অনুষ্ঠানটা, আমাদের এলাকার সবার মিলনমেলার সবচেয়ে বড় একটি অংশ ছিল, যেখানে হাসি-আনন্দে সময় কাটতো আমাদের। 

প্রবাসেতো সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, কাজের মাঝে বিলিয়ে দেন পরিপূর্ণভাবে। অন্যদিকে দেশের মায়ার কারণে মন খুলে হাসাও হারিয়ে ফেলেন। অনুষ্ঠানটা আমাদের সবার মনে আনন্দের খোঁরাক যোগাতো। দেশ ও পরিজন থেকে দূরে থাকলেও মনে আনন্দ ছড়িয়ে দিত, সতেজ করে দিত। আমার কিছুতেই এই আয়োজনগুলোকে হারিয়ে যেতে দিতে ইচ্ছে হতো না। তাই ভাবতাম, নিজ থেকে কি কি উদ্যোগ নিতে পারি, যা আবারও সবার মাঝে উৎসাহ আর সতেজতা সঞ্চার করবে। সবসময় মাথায় ঘুরতো আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। 

২০১৫ সালের কথা, আমি আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে শেয়ার করলাম আমার ভাবনার ব্যাপারে, জানালাম ইচ্ছার কথা। তারা আগ্রহ সহকারে শুনলো। শুনে খুশি হলো এবং সানন্দ্যে রাজি হয়ে গেলো। কথা দিলো, যে কোনো ব্যাপারে তারা আমার পাশে থাকবে। আমার মনে আবারও সুবাতাস বইতে শুরু করলো। আয়োজনগুলো কীভাবে করবো, তা নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম। 

আমার পরিচিত কিছু আর্টিস্ট ছিলেন, যারা বেশ ভালো গান করেন, কেউ নাচে পারদর্শী, কেউ মধুর সুরে সাক্সোফোন বাজাতে পারেন, কেউ ভিডিও করতে জানেন, আবার কেউ মুগ্ধ করা পেইন্টিং করতে জানেন। একে একে তাদের সবার কাছেই গেলাম। তারা আমায় ফিরিয়ে দিয়ে হতাশ করলো না। বরং আগ্রহ সহকারেই প্রোগ্রামে আসতে রাজি হলো। বাকি থাকে স্টেজ এবং খাবারের দিকটা। আমার এক বন্ধু একটি এনজিওর সঙ্গে আমায় যোগাযোগ করিয়ে দিলো, যারা খাবারের দায়িত্বটা নিয়ে নিলো। আর অন্যদিকে স্টেজ সাজানোর দায়িত্ব দিলাম এলাকার বড় ভাইদের। এভাবেই স্বল্প বাজেটের মধ্যে বৈশাখী মেলার আয়োজন শুরু করলাম। দিন-রাত জেগে অনুষ্ঠানের পোস্টার তৈরি করলাম।

আবহওয়া কিছুটা প্রতিকূলে ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেগুলো লাগিয়ে ফেললাম। এরপর দাওয়াত দেওয়ার পর্ব শুরু করলাম, আনাচে-কানাচে থাকা সব বাঙালিদের জানালাম। ফেসবুকে একটি পেজ তৈরি করে সেখানেও ইভেন্ট খুলে সবাইকে আমন্ত্রণ করলাম। কিন্তু একি হলো! শুনতে পেলাম ১৪ তারিখে নাকি অনেক ঝড় হবে, তাই অনুষ্ঠানকে আরও এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে হবে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তারপরও আশাহত হইনি, অপেক্ষা করছিলাম। সবার মনে আনন্দ বিলিয়ে দিতে হবে এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। ২৬ এপ্রিল নতুন তারিখ ঠিক করা হলো। সেদিন ভোর না হতেই সবকিছু চেক করা শুরু করে দিলাম। নাহ, সব ঠিক আছে।  কিছুক্ষণপর মিষ্টি রোদ আসা শুরু হলো। পাশাপাশি পেলাম সতেজ কোমল ফুলের ঘ্রাণ।  আহা, কি সুন্দর সকাল ছিল সেদিন! শুরু হয়ে গেলো অনুষ্ঠান। 

সেদিনও আমি শাড়ি পরেছিলাম। আমার দেখাদেখি আমার কোরিয়ান বান্ধবীরাও শাড়ি পরেছিল। দেখে কি যে ভালো লেগেছে আমার! কোরিয়ান, ফিলিপাইন, নেপালী আর্টিস্টরাও ছিলেন, তাদের কারণে অনুষ্ঠানটা আরও জমে উঠেছিল। আমার এত ভালো লাগা কাজ করছিল যে, তা লিখে প্রকাশ করার মতো না। সবার মুখে হাসি দেখে আমার চোখ ভিজে গেলো। আমি ভাবতে পারিনি যে আমার পাশে এত মানুষ এসে দাঁড়াবে, হাত বাড়িয়ে দেবে, উৎসাহিত করবে। আমন্ত্রিত অতিথিদের দেখে মনে হয়েছে তারাও অনেক বেশি উপভোগ করেছেন।

খুব ভালো মানের না হলেও অনেক বাধা থাকা সত্ত্বেও একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পেরেছি এটাই আমার জীবনের অন্যতম সফলতা। বার বার মাথা ঘুরছিল, দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, সেসময়ে বাকিরা যদি আমার পাশে এসে না দাঁড়াতো, সবাই মিলে যদি একসঙ্গে কাজ না করতো, তাহলে এই আয়োজন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আজও যখন আমি দিনগুলোর কথা ভাবি, মনের অজান্তেই মুখে তৃপ্তির হাসি চলে আসে। আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি।  

প্রবাসে আমরা হয়তো কেউ কারো রক্তের আত্মীয় নই, তবে সবাই আমরা একে অপরের আত্মার আত্মীয়। এই আয়োজনগুলোই তা প্রমাণ করে দেয়, আমাদের সবার মাঝে টান ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করে তোলে। প্রবাসে থেকেও আমরা বাঙালিরা যে আমাদের শেকড় ভুলে যাইনি, তাই সবার নিকট রঙ্গিনভাবে ফুটিয়ে তোলে আর বাঙালিদের সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর কাছে শক্তভাবে জানান দেয়। সবাইকে বৈশাখের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

ঢাকা/সাব্বির/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়