ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা বলয় প্রয়োজন

ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ১৭ মে ২০২১   আপডেট: ১৭:৩৪, ১৭ মে ২০২১
শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা বলয় প্রয়োজন

রাজশাহী শহরে সকালে হাঁটতে বের হলে একটি বিষয় খুব সহজে চোখে পড়ে, সেটি হচ্ছে রাস্তায় প্রচুর সাইকেল আরোহী। শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গ্রাম থেকে প্রচুর মানুষ (বিশেষ করে পুরুষ) সাইকেল চালিয়ে শহরে প্রবেশ করে। সাইকেলের পেছনের সিটে বাঁধা থাকে তাদের দিনমজুরি কাজের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন-কোদাল, ঝুড়ি ও শাবল। তাদের বেশিরভাগ শহরের নির্মাণ শ্রমিক ও রাস্তা মেরামতের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। 

কাজ পাওয়ার জন্য তারা শহরের ভদ্রা, রেইলগেইট ও তালাইমারি মোড়ে অপেক্ষা করতে থাকে। অপেক্ষামান সবাই কাজ পায় তা কিন্তু নয়। দুপুর ১২টা বেজে যায় তখনও দেখা যায় যে তারা কাজ পায়নি। সেখানেই বসে থাকে। আর আশা করে যে কেউ দিনমজুর খুঁজতে সেখানে আসবে আর তাদের কাজে নিয়োগ দেবে। কাজ পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করে তারা চা, বিস্কুট বা পান খেয়ে সময় কাটাতে থাকে।

এমন চিত্র সব শহরেই কম-বেশি দেখা যায়। গ্রাম থেকে কাজ খুঁজতে আসা লোকগুলো অধিকাংশই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয় এবং কোনো বিশেষ কাজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত নয়। তাই তারা দিনমজুর হিসেবে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি (informal economy) বা খাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাত বলতে সেগুলোকেই বোঝায়, যেসব অর্থনৈতিক কার্যক্রমে আনুষ্ঠানিকতা (রেজিস্ট্রেশন, আয়কর) নেই। সাধারণত, অদক্ষ, অশিক্ষিত ও অসচ্ছল পরিবারের লোকেরা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির উপর নির্ভর করেন। বলাবাহুল্য, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে চাকরির কাল ক্ষণস্থায়ী এবং তা মৌখিক চুক্তির উপর নির্ভর করে। বলা বাহুল্য, এই খাতের শ্রমিকরা ঈদ বোনাস বা উৎসব ভাতা পান না। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি খাতে আয়ের বহু মাধ্যম রয়েছে যেমন- রাস্তা মেরামত, মাটি কাটা, ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মাল টানা, পরিবহণের হেল্পার এমন আরও বহুবিধ।

করোনাভাইরাস  (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে এই সব পেশার মানুষের জীবিকা এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। করোনাভাইরাস তাড়িত দুর্যোগটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশও এই দুর্যোগ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। জনসমাগম এড়াতে ও মানুষের গতিবিধি সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত রাখতে স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন লকডাউন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি ঠেকাতে ‘লকডাউন’ কর্মসূচি অত্যন্ত কার্যকরি পদক্ষেপ। কিন্তু স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে লকডাউন কর্মসূচির কারণে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে নিম্ন আয়ের মানুষের অনিশ্চিত জীবন ও জীবিকা।

অনানুষ্ঠানিক খাতে সময়মতো ও ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রাপ্তির বিষয়টি অনিশ্চিত। এই খাতে শ্রমিকদের জন্য insurance বা সংকটকালীন সময়ে রক্ষামূলক ব্যবস্থা নেই। ফলে করোনাকালের লকডাউন অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে যুক্ত নিম্ন আয়ের মানুষকে কষ্টকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। ‘কাজ নেই তো আয় নেই’-এটি তাদের জীবনের নির্মম বাস্তবতা। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে তাদের আয় কমেছে। কারও আয়ের উপায় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের খাদ্য তালিকায় নিম্ন মানের ও সস্তা খাবার যুক্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতি তাদের অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। এক কথায়, এই পরিস্থিতি তাদের দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

রাজশাহী শহরের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি খাতের লোকজনের আয় কমেছে। বিশেষ করে যারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ও তার আশেপাশে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। কারণ, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে মানে হচ্ছে প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো মানুষ রাজশাহী থেকে চলে গেছেন বা তাদের চলাচল (mobilit) আগের মতো নেই। রিকশায় বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার সময় রিকশাওয়ালা বা অটোরিকশাওয়ালারা জানতে চায় কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। তাদের সবাই তাদের কষ্টের কথা বলেন। একজন বলেন, ‘কবে যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে! আমাদের আয়-রোজগার তো বন্ধ হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা থাকলে তারা রিকশায় উঠে, আমরা ভাড়া মারতে পারি। এখন তো আয় নেই। ঠিকমতো জমার টাকাই উঠে না। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি।’

এই ধরনের মানুষের সহায়তা করার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে। কিন্তু তা সীমিত পরিসরে হয়ে থাকে। সরকারের ‘সামাজিক নিরাপত্তা বলয়’ (social safety net)-এর অধীনে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম চালু আছে। যেমন- বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, কাজের বিনিময় খাদ্য এবং এমন আরও বহুবিধ প্রোগ্রাম। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কর্মসূচিগুলোর অন্যতম উদ্দেশ্য নিম্ন আয়ের মানুষ যেন অনাহারে না থাকে এবং দারিদ্র্যের মধ্যে যেন নিমজ্জিত না হয়। করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কার্যকরি বিস্তৃতি প্রয়োজন। 

গ্রামীণ বাংলাদেশে বহু অঞ্চলের মানুষ নিয়মিতভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয় এবং তারা বছরের একটি মৌসুমে বিপদাপন্ন (vulnerable) অবস্থায় থাকে। তাদের বড় একটি অংশ শহরে এসে অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতি তাদের বিপদাপন্ন অবস্থাকে আরও মন্দতর করে তুলেছে। এই সংকটময় অবস্থার সাথে তারা যেন টিকে থাকতে পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের চলমান সামাজিক নিরাপত্তা বলয়কে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। 

সামাজিক নিরাপত্তার প্রোগ্রামগুলোকে আরও বহুমুখী করা প্রয়োজন, যাতে কোনো ধরনের বিপদাপন্ন মানুষ সেই বলয়ের সুযোগ-সুবিধা থেকে বাদ না পড়ে। বিপদাপন্ন মানুষের বা পরিবারের তালিকা হালনাগাদ করা প্রয়োজন, যাতে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট নতুন বিপদাপন্ন ব্যক্তি বা পরিবার এই বলয়ে যুক্ত হতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে যে হালনাগাদের কাজটি যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পড়ে।

সম্প্রতি, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ পরামর্শ দিয়েছে যে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষকে দীর্ঘ সময়কালীন আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন (দ্য ডেইলি স্টার, ২৯ এপ্রিল ২০২১)। প্রতিষ্ঠানটি আরও উল্লেখ করে যে, নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য সুরক্ষার স্বার্থে সমস্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর উপর কর হ্রাস করা প্রয়োজন। অনুমেয়, করোনা দুর্যোগের প্রভাব খুব শিগগিরই শেষ হবে না। এটির প্রভাব এক যুগেরও বেশি সময় ধরে থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন। তাই, গরীব ও নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য সুরক্ষা তথা বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘকালীন সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচি গ্রহণ ও তা গুরুত্বের সাথে কার্যকর করা জরুরি। তা না হলে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি খাতের উপর নির্ভরশীল মানুষ অমানবিক কষ্টকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

রাবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়