ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আমার নরওয়ের ডায়েরি

ইশরাক সিদ্দিকী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৯, ২০ মে ২০২১   আপডেট: ১৪:২৩, ২০ মে ২০২১
আমার নরওয়ের ডায়েরি

ডায়েরি লেখার অভ্যাস যাদের রয়েছে, তাদের কাছে ডায়েরি একেকটা উপন্যাসের চেয়েও বেশি কিছু। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা বলেই হয়তো। ডায়েরিতে লেখা প্রত্যেক পৃষ্ঠায় মানুষের জীবনের স্বপ্নের কথা লেখা থাকে, থাকে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা, সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার গল্প। অন্যের জীবনের সেই ডায়েরি অনেকের জন্য আবার হতে পারে অনুপ্রেরণার খোরাক, কারো জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় সামান্য একটু সহযোগিতা। যারা নরওয়েতে পড়াশোনার উদ্দেশে আসতে চান, হয়তো আমার নরওয়ের ডায়েরি কিছুটা হলেও তাদের সহযোগিতা করবে। 

ভাইকিংসের দেশ নরওয়ে। অরোরা বোরিয়ালিসের দেশ। নিশীথ সূর্যের দেশ। এদেশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ আগ্রহ রয়েছে, সেটি লক্ষ্য করেছি এদেশে আসার পর থেকেই। আমার বাংলাদেশি সঙ্গী যারা আছেন, কিভাবে নরওয়েতে আসা যায়, জানার ব্যাপারে তাদের কাছেও হরহামেশা ফোন আসে।

বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে কোনো তথ্য বের করাটা খুব কঠিন কিছু নয়। তবে, নরওয়েতে আসার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং বেশ কিছু পেপারওয়ার্কের ঝক্কি রয়েছে। নিজ দেশ ছেড়ে অন্য একটি অপরিচিত জায়গায় পাড়ি দিতে হলে ইনফরমেশন নিজে খুঁজে বের করাটাই ভালো। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং মতামত, এতে অনেক ব্যাপারে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা যায়।

নরওয়েতে আসার আগে বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের আলো-বাতাসে অভ্যস্ত শরীর এখানে পরিণত হবে রুক্ষ পাথরের মতো, সোজা বাংলায় হাঁড় কাঁপানো শীতে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল দেশ নরওয়ে এবং এরা নিজেদের গোপণীয়তাকে খুবই প্রাধান্য দেয়। এখানে কোনো বর্ণবাদ নেই, সবসময় সবাইকে সহযোগিতা করার মানসিকতা প্রায় বেশিরভাগ নরওয়েজিয়ানের মধ্যে থাকলেও এরা নিজেদের ব্যক্তিগত সময়কে ভীষণ ভালোবাসে।

তবে একটি দিক দিয়ে নরওয়ে বাকি সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য। পৃথিবীর গুটিকয়েক দেশের মধ্যে নরওয়ে হচ্ছে উল্লেখযোগ্য, যারা টিউশন ফি’তে সম্পূর্ণ ছাড়ে শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে, তবে সব কোর্সে নয়। তাই হয়তো এদেশে এডমিশন ও ভিসা পাওয়াটা কঠিন। তবে, অসম্ভব নয়। আবেদন প্রক্রিয়ার জন্য ওদের নিজস্ব ডাটাবেজ আছে। নরওয়ের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, স্কুলগুলোর তালিকাগুলো এই ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে https://fsweb.no/

আবেদন করতে হলে এই ওয়েবসাইটে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা একাউন্ট খুলতে হয়, সেই একাউন্টের মাধ্যমেই ডকুমেন্টস আপলোড করতে হয়। পছন্দের কোর্স বাছাই করার জন্যও আগ্রহী শিক্ষার্থীরা এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করে থাকেন।

তার আগে ছোট্ট একটি কাজ করে নিলে ভালো। ‘স্টাডি ইন নরওয়ে’ লিখে সার্চ করলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। নরওয়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছরে একবার আবেদন করা যায়। সাধারণত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে এই সেশন। এই সময়ের মধ্যে আবেদন না করলে এক বছর পিছিয়ে যেতে হবে।  শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যই আইইএলটিএস স্কোর থাকতে হবে।  ব্যান্ড স্কোর ৬ এর অধিক যত উপরে থাকবে, সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। আবেদনের পর বেশ কয়েক মাস, আনুমানিক মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত সময় লাগে এডমিশন মিললো কিনা সেটি জানতে। অবশ্যই ই-মেইল চেক করতে হবে প্রতিদিন। কারণ যে কোনো ধরনের তথ্য অথবা প্রশ্নের উত্তর জানতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে শুধু একটা ই-মেইল পাঠিয়ে দিন।

এরপর তারাই পরবর্তী করণীয় জানিয়ে দেবে আপনাকে। তাছাড়া নরওয়েতে কোর্স ভেদে শিক্ষার্থী বাছাইয়ের ধরনে রয়েছে ভিন্নতা। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে পরখ করতে স্কাইপ ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, মোটিভেশন লেটারের প্রতি জোড় দেওয়া উচিৎ। কারণ লক্ষ্য, সামর্থ্য, প্রতিভার জানান দিয়ে কর্ম হাসিল করার সেরা মাধ্যম হচ্ছে মোটিভেশন লেটার।

এডমিশন হয়ে গেলে শুরু করুন ভিসা পেতে ছোটাছুটি। জেনে রাখা ভালো, বাংলাদেশে নরওয়ের এম্বাসি নেই। তবে কনস্যুলেট আছে! সুবিধা হচ্ছে, ঢাকায় অবস্থিত ডেনমার্ক এম্বাসি নরওয়ের ভিসা প্রসেস করে। আমাদের একটি ধারণা রয়েছে যে, এম্বাসিতে গিয়ে প্রশ্ন করলেই হয়তোবা ভিসা সংক্রান্ত তথ্যগুলো জানা যাবে। যেটা একেবারেই ভুল। আপনি কীভাবে যাবেন, কী কাগজপত্র লাগবে, এগুলো সবই আপনার নিজের ঘেঁটে বের করতে হবে। তবে কনস্যুলেট থেকে শিক্ষার্থীদের ই-মেইলে কিছু ওয়েবসাইটের লিঙ্ক পাঠানো হবে। যেখানে ভিসার আবেদনে যে যে ডকুমেন্টস লাগবে, তার তথ্য দেওয়া থাকে।

এরপর ‘ভিএফএস গ্লোবাল’-এ আপনার যাবতীয় পেপারস জমা দিন। আপনার পেপারগুলো এরপর ডেনিশ এম্বাসির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করবে ইউডিআই (UDI)। নরওয়েজিয়ান ইমিগ্রেশন অথরিটির সংক্ষেপ হলো ইউডিআই।  www.udi.no/en ওয়েবসাইটে নরওয়ের ইমিগ্রেশন নিয়ে তথ্য রয়েছে। স্টুডেন্ট ভিসা ছাড়াও সেখানে পাওয়া যাবে অন্যান্য ক্যাটাগরিতে নরওয়েতে আসার নির্দেশনা।

তবে ভিসা পাওয়ার আগে একটা জটিল ধাপ পেরোতে হবে। আর সব দেশের মতোই নরওয়ের ক্ষেত্রেও থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ বেশ কিছু টাকা ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। নরওয়ের নিয়ম হলো, এই টাকা শিক্ষার্থী অথবা তার স্পন্সরের নিজ দেশের ব্যাংক একাউন্টে রাখা যাবে না, পাঠিয়ে দিতে হবে নরওয়েতে স্টুডেন্ট যে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসবে, তাদের একাউন্টে। চিন্তা করার কিছু নেই, আপনার টাকা নিরাপদেই থাকবে। 

ভিসা না হলে, এম্বাসি থেকে রিজেকশনের কপি কর্তৃপক্ষের কাছে ই-মেইল করলেই আপনার টাকা ফেরত চলে আসবে। তবে ব্যাংক ট্রান্সফারে কারেন্সি কনভার্সনের কারণে কিছু টাকা গচ্ছা যাবে। ভিসা হয়ে যাওয়ার পর নরওয়েতে চলে আসলে স্টুডেন্ট এই টাকা তুলতে পারবেন। তবে পুরো টাকা আপনার নরওয়েজিয়ান ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করতে বেশ কিছু দিন সময় লাগবে। নরওয়েতে প্রতিবছর রেসিডেন্স পারমিট রিনিউ করতে হবে। এক বছর পর পর ভিসা রিনিউর সময় আপনাকে এই পরিমাণ টাকা ব্যাংক একাউন্টে জমা রাখতে হবে।

মনে রাখবেন, আপনাকে ডেনিশ এম্বাসি থেকে এক-দুই মাসের এন্ট্রি ভিসা দেওয়া হবে। নরওয়েতে এসেই আপনাকে পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করতে হবে। বাংলাদেশে বসেই পুলিশ স্টেশনে অ্যাপয়েন্টমেন্টের তারিখ ঠিক করে রাখা যায়। অথবা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসবেন, তারাও সব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের একাট্টা করে পুলিশ স্টেশনের কাছ থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়। সেক্ষেত্রে সময় কিছুটা বেশি লাগে। এরপর আপনাকে দেওয়া হবে এক বছরের জন্য রেসিডেন্স পারমিট! যার মাধ্যমে আপনার জন্য খুলে যাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণের সুযোগ।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ভাইকিংদের উত্তরসূরীরা চাইছে তাদের দেশকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করতে। তাই সেই লক্ষ্যে তাদের দেশের প্রত্যেক নাগরিক, স্টুডেন্ট, পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম পাওয়া সবার জন্য ইউনিক কোডের ১১ ডিজিটের পার্সোনাল নম্বর ইস্যু করে। আপনাকেও যত দ্রুত সম্ভব ব্যক্তিগত নম্বরের জন্য আবেদন করতে হবে। এই পার্সোনাল নম্বর হাসপাতাল থেকে শুরু করে ব্যাংক একাউন্ট, চাকরির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা জায়গায় প্রয়োজন হবে।

পার্সোনাল নম্বর হয়ে গেলে আপনার ব্যাংক একাউন্ট হতে ৪-৬ সপ্তাহ সময় লাগবে। এই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে, দেশ থেকে পাঠানো টাকা নিজের একাউন্টে পেতে। তবে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এই সময় পর্যন্ত আপনি কীভাবে চলবেন? তার জন্যও রয়েছে সমাধান। আপনি যাদের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন, সেই অফিসের অথরিটি আপনাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ নরওয়েজিয়ান ক্রোনার ক্যাশ কার্ড দেবে। সেই ক্যাশ কার্ডের মাধ্যমে আপনি এটিএম মেশিন থেকে ক্যাশআউট করতে পারবেন।

সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা ওয়ার্কপারমিট রয়েছে স্টুডেন্টদের জন্য। তবে নির্ধারিত ঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কাজ করলে অথবা কোনোভাবে প্রতারণার দায়ে ফেঁসে গেলে পরের বছর ভিসা পাওয়ায় শঙ্কা দেখা দিতে পারে। আরও একটি বিষয় জানিয়ে দেই, নরওয়েজিয়ান ভাষার বেশ গুরুত্ব আছে। ভাষা জানলে চাকরি পাওয়া সহজ। আর ঘণ্টা প্রতি বেতন কাঠামো অন্যান্য দেশের তুলনায় ঢের বেশি।

পরিশেষে, সহজ-কঠিনে মেশানো নরওয়ের জীবন। এখানে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের কমিউনিটি বড় হচ্ছে। আর প্রতিবছর এদেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, যাদের মাধ্যমে নরওয়েতে বেড়ে উঠছে বাংলাদেশও। আর পৃষ্ঠা ভরছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নরওয়েজিয়ান ডায়েরির। আবার হয়তো কখনো নরওয়ের ডায়েরি মেলে ধরবো পাঠকদের উদ্দেশ্যে। শুভকামনা রইলো। শুভ হোক পথচলা।

লেখক: নরওয়ে প্রবাসী শিক্ষার্থী।

সাব্বির/মাহি  

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়