ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খোলা চাই

মাসুম মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৭, ৩ জুন ২০২১   আপডেট: ১৬:২০, ৩ জুন ২০২১
স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খোলা চাই

উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেন লাখো শিক্ষার্থী। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এসে স্বপ্ন দেখেন নতুনের, স্বপ্ন দেখেন নিজেকে শ্রেষ্ঠতম নাগরিক হিসেবে তৈরির। প্রথম বর্ষে পদার্পণকালে শিক্ষার্থীর আচরণগত ও বাহ্যিক ভঙ্গি বছরেই যেন পরিণত হয়ে গড়ে ওঠে দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বে। কিন্তু করোনাকালে এই সুযোগটাই যেন আর পেয়ে ওঠা হলো না ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীদের। 

সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতেই তালা ঝুলে উঠলো ক্লাসরুমে। পুরো ক্যাম্পাসটা একবার ঘুরে দেখার আগেই তীব্র লকডাউন। এমন পরিস্থিতিতে হতাশায় ভুগছেন অনেক শিক্ষার্থী। শেষ বর্ষ ও আটকে থাকা পরীক্ষা নেওয়ার কথা বার বার তোলা হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের কথা। তারা বলছেন, কোনো প্রকারের শর্ত ছাড়াই খুলে দেওয়া হোক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে হতাশাগ্রস্ত এই শিক্ষার্থীদের অব্যক্ত কথা তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মাসুম মাহমুদ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে তাজরিয়ান ফারিয়াল তার মানসিক অবস্থার কথা জানিয়ে বলেন, ভর্তি যুদ্ধে কৃতকার্য হয়ে যখন একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম, ঠিক তার কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিবন্ধক হিসেবে বৈশ্বিক  মহামারি এলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, পড়াশোনার ধরন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝার আগেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে ঘরবন্দী হয়ে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। অনলাইনে যে ক্লাসগুলো হচ্ছে, মানসিক অস্থিরতার কারণে তাতে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করাই কঠিন হয়ে পড়ছে। যতটা মনোযোগ দিতে চাই, ততটা অপরিকল্পিত অনলাইন শিক্ষা আমাকে হতাশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে চাই, যে কোনো মূল্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিন। 

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম। কেমন আছেন? এই প্রশ্নের জবাবে আক্ষেপ নিয়ে বলেন, কেমন আছি জানতে চাচ্ছেন? আচ্ছা তাহলে শুনেন, শারীরিক দিক দিয়ে ভালো থাকলেও মানসিকভাবে মোটেও ভালো নেই। ভার্সিটি বন্ধ, দীর্ঘ এক বছর দুই মাস (প্রায়) অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হলাম, কিন্তু দেড় মাস ক্লাস হওয়ার পরেই অনিদৃষ্টকালের জন্য ভার্সিটি বন্ধ। ফলে ভার্সিটি সংস্কৃতি বুঝে ওঠার আগে সব কিছু হয়ে গেলো বিপর্যস্ত। 

বর্তমানে পড়াশুনা হয়ে উঠেছে ডিভাইস নির্ভর, ক্লাস অনলাইনে, পড়াশুনা অনলাইনে। আসলে অনলাইন ভিত্তিক পড়াশোনাটা হয়ে ওঠে না। পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে সামাজিক মাধ্যমে সময় বেশি দেওয়া হয়। সবকিছু মিলিয়ে মানসিকভাবে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত, বিশেষ করে সেশনজটের কথা মনে হলে খুবই খারাপ লাগে। আমি চাই এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ভার্সিটি খোলা হোক, আমাদের মানসিক বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেওয়া হোক। আমাদের স্বপ্নকে মুক্তি দেওয়া হোক।

উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া রহমান বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তিন-চার মাস পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুইমাস না পেরোতেই করোনা স্বাভাবিক জীবনযাপন বন্ধ করে দিলো। ঘরবন্দী জীবনে স্বাভাবিক জীবনযাপন ও পড়ালেখা করতে না পেরে আমরা মানষিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও অধিকাংশ সময় থাকে নেটওয়ার্কজনিত সমস্যা। বিপরীতে, মোবাইল ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেককেই সেশনজটে পরতে হচ্ছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা কাজ করে। আমাদের সাথে সাথে টেনশনে ভুগছে আমাদের পরিবারও।

কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান বলেন, সদ্য ভার্সিটিতে উঠে ভার্সিটির পরিবেশের সাথে পরিচয় হচ্ছি, এমন সময় করোনা মহামারি শুরু। সেইসঙ্গে লকডাউনের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর পড়াশোনার কাছ থেকে দূর হতে থাকি ক্রমেই। অনলাইনে ক্লাস হলেও ছিল না যোগাযোগ/নেটওয়ার্কের সুব্যবস্থা। ফলে আমাদের খুবই অসুবিধা হচ্ছিল ক্লাস করতে। তাছাড়া অনলাইন ক্লাসে আমাদের পাঠগুলো বুঝতেও সমস্যা হয়েছে। আমরা সবাই পিছিয়ে পড়েছি এই দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে। এই দীর্ঘ লকডাউনে আমাদের কোন উন্নতি নেই বরং ক্রমেই অবনতি হয়েছি। 

সুকান্ত বৈদ্য, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার হয়ে সবার স্বপ্ন থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায় পা রাখার, আমরা কিনা সেখানে এসে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকটাই ভালো করে চেনার আগেই সবাইকে ফিরে যেতে হয়েছে। স্বপ্নের জায়গায় কাঙ্ক্ষিত পরিবেশের সবকিছুর সাথে পরিচিত হওয়ার আগেই যেন সব শেষ হয়ে গেলো। 

অর্থনীতি বিভাগের তনিমা সুলতানা বলেন, এডমিশনের চাপের পর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হওয়ার একমাস যেতে না যেতেই করোনার ছুটিতে বাসায় চলে আসতে হয়। কিছুটা আরাম আর খুশি লাগলেও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে খুব ইচ্ছা করে। সারাদিন বাসায় বসে মানসিক অবসাদে ভুগতে হচ্ছে, তার উপর আছে প্রায় দেড় বছরের সেশনজটের আতঙ্ক। বিভিন্ন ধরনের শখের কাজ যেমন গাছ লাগানো, বই পড়া, রান্না করা এইসব করেই দিন কাটছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর ক্যাম্পাসের ব্যস্ততার সেই জীবনকে ভীষণভাবে মিস করি।

বাংলা বিভাগের মাঈনুল হক দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবি জানিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা রাখার পরে মাত্র দু’মাস ক্লাস করলাম। তারপর থেকেই করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে সরকার বার বার ছুটি বাড়িয়ে আজ প্রায় দেড়টা বছর শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে নষ্ট করে দিলো। সব কিছুই শিথিল করা হয়, বাস/ট্রেন/অফিস/বাজার এমনকি বিনোদন কেন্দ্র পর্যন্ত চালু করা যায়, শুধু শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে যত সমস্যা।

হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাজিয়া সুলতানা এ্যানি বলেন, ছাত্রাবস্থায় ক্যাম্পাসবিহীন জীবনটা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, তা এই মহামারি করোনাভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। শিক্ষার সঠিক চর্চা ও সমন্বয় তখনই হয়, যখন সেটা হাতে-কলমে ও সশরীরে অর্জন করা হয়। আমরা বিগত দেড় বছর ধরে জ্ঞান অর্জনের সঠিক চর্চা থেকে বঞ্চিত। বেঁচে থাকার জন্য যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার প্রয়োজন, তেমনই শিক্ষাও আমাদের অপরিহার্য মৌলিক অধিকার। কারণ, আমাকে জাতি মূল্যায়ন করবে শিক্ষা দিয়ে।

পড়াশোনার প্রতি অনিহা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। অনেকে হয়তো খারাপ আড্ডা ও খারাপ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর অপব্যবহার করছে, এমনকি বর্তমানে তারা কম্পিউটার গেমিং, পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেমের প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। বেকারত্ব, পারিবারিক অভাব-অনটন, ব্যক্তিগত সমস্যায়, একাকিত্বতায় ভুগে অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ অচল করে, শিক্ষার্থীদের জীবন ও ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে রেখে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব নয়।

ববি/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়