ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কৃত্রিমভাবে সোনা উৎপাদন কেন প্রয়োজন

রেদ্ওয়ান আহমদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৭, ৯ জুন ২০২১   আপডেট: ১৩:০৭, ৯ জুন ২০২১
কৃত্রিমভাবে সোনা উৎপাদন কেন প্রয়োজন

সোনা মানুষের আবিষ্কৃত সর্বপ্রাচীন মৌল। এটি পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান একটি ধাতু। প্রাচীন কাল থেকেই সোনার সঙ্গে মানুষের মোহ ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার সাথে জড়িত মানুষের লোভ-লালসা, রক্ত, ক্ষমতা ইত্যাদি। 

সেই নব্য প্রস্তর যুগ থেকেই সোনার তৈরি বিভিন্ন দামি দামি অলঙ্কার ও সহজ বিনিময় প্রথা এখনো সমানভাবে বিরাজমান। এটি এমন এক ধাতু, যেটি ক্ষয়হীন ও মরিচাবিহীন উজ্জল্য ও চকচকে বর্ণের। সোনাকে যেমন ইচ্ছে আকৃতি দেওয়া যায়। এর রাসায়নিক নাম ‘অরাম’। যাকে সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ দিয়েছিল মিশরীয়রা। এমনকি, তারা মনে করতো মৃত্যুর পরও ফারাওরা রাজা-বাদশা হয়ে থাকবে, তাই তাদের সমাধিতে প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণ-মুদ্রা পাওয়া যেতো।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, সোনা এ পৃথিবীর কোনো সাধারণ ধাতু নয়। এটি পৃথিবীর বাইরের কোনো একটি ধাতু। বিজ্ঞানীদের মতে প্রায় কয়েক বিলিয়ন বছর আগে মহাকাশে সুপারনোভা বিস্ফোরণ বা দুটো মৃত নক্ষত্র, নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষের মাধ্যমেই সোনার উৎপত্তি। যার থেকে অনবরত সোনা বৃষ্টি হচ্ছে। এরপর সময়ের বিবর্তনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর ভূ-তলের গভীরভাগে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এই সোনা। আরও মজার ব্যাপার হলো, আমরা আসলে পৃথিবীর এই গভীরভাগ থেকে সোনা তুলে আনিনি, বরং পৃথিবীর আদিকালে বিভিন্ন ছোট-ছোট গ্রহের সাথে পৃথিবীর প্রায়শই ভয়াবহ সংঘর্ষ হতো, সেই সংঘর্ষে পৃথিবীর তল-ভর পর্যন্ত কেঁপে উঠত। এবং এই ভয়াবহ সংঘর্ষের কারণেই ভূ-তলের অনেক সোনা মানুষের হাতের নাগালে এসে পৌঁছে যায়। যা আমরা এখন খনি থেকে উত্তোলন করে থাকি। কিন্তু খনি থেকেও আমরা সরাসরি চকচকে সোনা পেয়ে যাই না। এটা অনেকরকম পদার্থের সঙ্গে মিশে থাকে। যেমন, লোহা, তামা, মাটি ইত্যাদি। যেগুলোকে নানা প্রক্রিয়ায় পরিশুদ্ধ করে তা থেকে খাটি সোনা, ১৮ ক্যারেট, ১৪ ক্যারেট সোনা ইত্যাদি উৎপাদন করা হয়।

পৃথিবীর অর্থনীতিতে বরাবরই সোনা একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। যাদের হাতে সোনার পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুদ আছে, তারা পৃথিবীটাকে এক প্রকার রাজত্বও করছে বটে। এই সোনা বিশ্বের কম সংখ্যক মানুষের কাছেই আছে। বর্তমানে বিলাসবহুল অলঙ্কার থেকে ধরে ইলেক্ট্রনিক সার্কিট, গাড়িতে প্রলেপ, বিমানে প্রলেপ, শাড়িতে মোড়ানো ইত্যাদির জন্য এর ব্যবহার পূর্বের তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। পৃথিবীর মানুষ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এর চাহিদাও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সোনা নিয়ে যতোই তোলপাড় হোক না কেন, এর অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর ওজন। প্রাচীন কাল থেকে এযাবৎ কাল পর্যন্ত সংগৃহীত প্রায় দুই লাখ টন সোনা দিয়ে মাত্র ৬০ ফুটের একটি কিউব নির্মাণ করা সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোতে সমস্ত সোনার প্রায় ১৭ শতাংশ মজুদ আছে। মোট মজুদ করা সোনার পরিমাণ মাত্র অর্ধ লাখ টন। যা মানব চাহিদার চেয়ে অনেকগুণ কম। এই সোনার মজুদ আগামী দুই দশকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। ফলে, কৃত্রিমভাবেও স্বর্ণ উৎপাদনের দিকে ধাবিত হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিগুলো। তবে, ভূতাত্ত্বিকেরা বলছে, পৃথিবীর ভূ-ভাগে আরও প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন সোনা আছে। যা সময় সাপেক্ষ এবং আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে উত্তোলন করা সম্ভব। 

সোনার প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণ, মোহ সেই প্রাচীন কাল থেকেই। যার কারণে, মানুষের এই চাহিদার যোগান দিতে কৃত্রিমভাবে সোনা উৎপাদনের নানা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অ্যালকেমিস্টরা। তবে তেমনভাবে কেউই সফলতার মুখ দেখেনি। কিন্তু ২০০৯ সালে মার্কিন এ্যালকেমিস্টরা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন, যার দ্বারা বর্জ্যকে সোনায় রূপান্তর করা সম্ভব। এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করাও সম্ভব। 

এই ব্যাকটেরিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম ‘কাপারিয়াভিদাস মেটালিডুরানস’। তারা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে যে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো এক ধরনের বিশেষ বিষাক্ত তরল খেয়ে যে বর্জ্য ত্যাগ করে, তার থেকে ২৪ ক্যারেটের সোনা উৎপাদনে তারা সফল। আর সে বিষাক্ত তরলের নাম ‘গোল্ড ক্লোরাইড’। ব্যাকটেরিয়া মেটালিডুরানসকে গোল্ড ক্লোরাইডের সাথে কিছু দিন রেখে দিলে ব্যাকটেরিয়াগুলো সে তরলগুলো গ্রহণ করে শরীর থেকে তারা এক ধরনের বর্জ্য নিঃসরণ করে এবং তা থেকে বিজ্ঞানীরা খাঁটি সোনা সংগ্রহ করে। এই কৃত্রিমভাবে সোনা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ‘মাইক্রোবিয়াল এ্যালকেমি’ বলা হয়। তারা এটাও দাবি করে যে, এই প্রক্রিয়ায় সোনা উৎপাদন করলে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে তারা।

সম্প্রতি সুইস এ্যালকেমিস্টরা প্লাস্টিক দিয়ে সোনা উৎপাদনের দাবি করলে এ বিষয়ে ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় এক গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। সেখানে বিজ্ঞানী রাফায়েল মেজেঙ্গারের মতে, প্লাস্টিক দিয়ে একবারে ১৮ ক্যারেট সোনা উৎপাদন সম্ভব। তারা এই প্রজেক্টে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে।  

সোনা মূলত এক ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও এর বহুগুণ চাহিদার কারণে এর কৃত্রিমভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করা উচিৎ। কিন্তু বর্তমানে তা হচ্ছে বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জ। মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য কৃত্রিমভাবে সোনা উৎপাদনের বিকল্প নেই। 

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

চবি/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়