ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পা দিয়ে লিখেই জীবনযুদ্ধে জিতছেন আমিনুল

এইচ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৬, ১০ জুন ২০২১   আপডেট: ১৭:০২, ১০ জুন ২০২১
পা দিয়ে লিখেই জীবনযুদ্ধে জিতছেন আমিনুল

আমিনুল ইসলাম। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার খিদিরপুর ইউনিয়নের মনতলা গ্রামের বাসিন্দা। বাবা মফিজ উদ্দিন আফ্রাদ। জন্মের পর থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী আমিনুল। দুই হাত পুরোপুরি অকেজো, দুই পা’য়েরও প্রায় একই অবস্থা। হাঁটতেও পারেন না। শুধু হাঁটুতে ভর দিয়ে কোনো রকমে চলাফেরা করেন। কিন্তু এ প্রতিবন্ধকতা থামাতে পারেনি আমিনুলকে।

অদ্যম সাহস আর মনোবল নিয়ে তিনি দুই পায়ে লিখে চালিয়ে গেছেন ছাত্রজীবনে পড়াশোনা। দারুণ প্রত্যয়ী আমিনুল এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন সাফল্যের সঙ্গেই। ২০১৭ সালে বাড়ির পাশেই কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। এখন তিনি পরিপূর্ণ শিক্ষক। পায়ে লিখেই দীর্ঘ চার বছর ধরে সুনামের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। পরিবারের চার সদস্য তার এই সামান্য আয়েই চলে।

সব সমস্যাকে ‘সামান্য’ বানিয়ে অসামান্য সাহসের সঙ্গে আমিনুল জিতে চলেছেন জীবন লড়াই।

১৯৮২ সালে মনতলা গ্রামের দরিদ্র কৃষক মফিজ উদ্দিন আফ্রাদের ঘরে জন্ম আমিনুলের। মফিজ উদ্দিনের দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে আমিনুল দ্বিতীয়। তার হাতে-পায়ের সমস্যা জন্মগত। জন্মের তিন মাসের মাথায় তার বাবা মা ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ডাক্তারের পরামর্শ নেন। কিন্তু বাবার আর্থিক অনটনের কারণে তার আর চিকিৎসা করা হয়নি। পঙ্গুত্বকে সঙ্গী করেন বেড়ে উঠেন আমিনুল। মেধাবী আমিনুল এভাবেই নেমে পড়েন জীবন যুদ্ধে। 

শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে কোনো বাধা মনে না করে মনতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে পায়ে লিখে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেন আমিনুল। ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অদ্যম সাহস নিয়ে পায়ে লিখেই টপকে যান শিক্ষাজীবনের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

 ২০০৯ সালে খিদিরপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যিক বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। কুমিল্লা আকবর আলী খাঁন কারিগরি বাণিজ্যিক কলেজ থেকে ২০১১ সালে বাণিজ্যিক বিভাগে অংশ নিয়ে জিপিএ ৪.০০ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। বিএ কোর্সে ভর্তি হলেও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি।

আমিনুলের দৃঢ়তা এবং ইচ্ছেশক্তি সত্যিকার অর্থেই অনুকরণীয়। মানুষ কখনো হারে না, শ্বাশত সেই সত্যটাই আমিনুলের জীবন কাহিনী। শত বাধাও তাকে থামাতে পারেনি। 

হাত নেই তো কি হয়েছে? পা দিয়ে তো লেখা যায়! যেই চিন্তা সেই কাজ। পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিয়েছেন। পাস করেছেন। এখন শিক্ষকতা করে জীবন সংসার সামাল দিচ্ছেন। কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাতেননি। নিজের উ”” শিরকে নত হতে দেননি।

২০১৭ সাল থেকে খিদিরপুর আফজালুল উলুম কওমী মাদ্রাসার বাংলা, ইংরেজি ও গণিত শেখান আমিনুল। সুনামের সঙ্গেই শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও তার পাঠদানে মুগ্ধ।

 মাদ্রাসায় তার মাসিক বেতন যৎসামান্য।  সেই সামান্য অর্থ এবং প্রতিবন্ধী ভাতার আয়ে স্ত্রী, দু’ছেলেসহ চারজনের সংসার চালানো খুবই কঠিন। জমিজমা নেই। আর্থিক কষ্ট আছে কিন্তু জীবনকে জেতার তার অসামান্য জেদের কাছে সব কষ্টই যে পরাজিত।

পায়ের সঙ্গে দুই হাতও অকেজো হওয়ায় চলার জন্য হুইল চেয়ার ব্যবহারও  করতে পারেন না আমিনুল। হাঁটুতে ভর করে শ্রেনিকক্ষে পায়ের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে চক ধরে বোর্ডে লিখে পাঠদান করে চলেছেন শিক্ষার্থীদের। 

স্থানীয়রা জানান, আমিনুলের শুধু ভিটা-মাটি ছাড়া চাষ করার মতো একটু জমিও নেই। জমি চাষ করার মতো শারীরিক সক্ষমতাও নেই। তবে সীমাহীন এই কষ্ট নিয়েও পরম যতেœ ছাত্রদের শেখাচ্ছেন আমিনুল। 

নরসিংদী সুইড বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমিনুলের যে অদম্য ইচ্ছা শক্তি রয়েছে, সত্যিই প্রশংসনীয়। বর্তমানে একটা প্রতিবন্ধী ভাতা ও মাদরাসার যৎসামান্য বেতনে পরিবারসহ তার চলা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় আমিনুলের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলসহ সমাজের দানশীলদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’

নরসিংদী/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়