ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমার অক্সফোর্ড যাত্রার ইতিবৃত্ত

মোহাম্মদ উজ্জ্বল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২১, ১২ জুন ২০২১   আপডেট: ১৪:২৯, ১২ জুন ২০২১
আমার অক্সফোর্ড যাত্রার ইতিবৃত্ত

বিশ্বসেরা বিদ্যাপীঠ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্নের বীজটা স্বপ্নদুয়ারে রোপণ করেছিলাম ঠিক তখনই, যখন বিজ্ঞানী হওয়ার তীব্র বাসনা ও আকাঙ্ক্ষার এক দুঃসাহসিকতার পাল তুলেছিলাম। এই দুঃসাহসিকতার অভিযানে নির্ভীক অভিযাত্রী যে আমি হতে পারব, এ নিয়ে আমার মনে কোনো সংশয় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষ থেকেই আসলে এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য একাডেমিক পড়ালেখার বাইরেও গবেষণা কর্মকাণ্ড নিয়ে কঠিন অধ্যবসায়ে নিমজ্জিত ছিলাম।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য যেই যোগ্যতার প্রয়োজন, সেগুলোতে প্রতিনিয়ত চোখ বুলিয়ে রাখতাম, আর সে অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মগ্ন থাকতাম। যেহেতু আমি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম, সেই সময় থেকেই গবেষণার প্রতি জোর দিতাম, পাশাপাশি দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম। ফলে জার্মানি, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, জাপান, হংকংসহ বিভিন্ন দেশে গবেষণা ও তাদের ল্যাব পরিদর্শনের সুযোগ পাই, যা অক্সফোর্ডে পড়ালেখা করার আমার প্রবল ইচ্ছাকে ব্যাকুলভাবে আন্দোলিত করে তোলে। এরই মধ্যে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ২৪টি দেশের প্রতিযোগীদের নিয়ে গবেষণা–সংক্রান্ত দুই মাস মেয়াদী একটি আয়োজনে একজন প্রতিযোগী হিসেবে আমার সুযোগ মেলে। জার্মানির ৮টি গবেষণাগারে গবেষণার সুযোগের পাশাপাশি দেশটির বিখ্যাত সব গবেষকদের একান্ত সাহচর্যও পাই। এই অভিজ্ঞতাগুলো আমার পরবর্তী জীবনে বিজ্ঞানী হওয়ার তীব্র অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। গবেষণা ক্যাম্প শেষে প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ স্কোর অর্জন করে, আমি জার্মানির প্রসিদ্ধ DAAD স্কলারশিপ লাভ করি। কিন্তু বিধিবাম! আমার স্বপ্ন যে পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।

জার্মান সরকারের বৃত্তি নাকচ করে দিই। কিছুটা মন খারাপ হলেও অক্সফোর্ডে পড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকায় এটিকে তুচ্ছ মনে হয়েছে। বলে রাখা ভালো, আমি ততদিনে কিন্তু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনই করিনি। আমি শুধু নিজেকে তৈরি করছিলাম এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস তৈরি করছিলাম যে, আমি অক্সফোর্ডে সুযোগ পাব। এরই মধ্যে ২৫টির মতো রিসার্চ পাবলিকেশনস, আইইএলটিএস স্কোর ৭.৫ (প্রত্যেক ব্যান্ডেই ৭ এর ওপর) এবং অন্যান্য মানদণ্ড (CGPA, Motivation Letter, Conference, Research Fund, Extracurricular activities) ইত্যাদি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করি। বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অফার পেয়েও যাই। কিন্তু অফার পাওয়ার পরও কেন জানি মন সায় দিচ্ছিলো না। কেননা, অক্সফোর্ডে পড়ার স্বাদ আমার চাই-ই চাই।

সময়টা ২০১৮ সাল, আমার স্বপ্নের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সাথে তিনটি ডিপার্টমেন্টে আবেদন করি। বেশ কয়েকজন অধ্যাপককে ই-মেইলও দেই। সেসব ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হলো। প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হলো সাক্ষাতকারগুলো। ফলাফল ই-মেইলে জানিয়ে দেওয়া হলো। সেদিন ছিলো আমার জন্য স্বরনীয় দিন, কারণ আমি অক্সফোর্ডে পড়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছি! আমিতো এই দিনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো পড়ালেখার খরচ, মানে ফান্ডিং নিয়ে। নির্বাচিত হয়েও ফান্ডিংয়ের অভাবে সেই বছর আমার আর পড়া হলো না স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে ফের আবেদন করলাম। আবারো সুযোগ পেলাম তবে এবারো ফান্ডিংয়ের অভাব। এরই মধ্যে অক্সফোর্ডের একজন অধ্যাপককে রাজি করালাম। কিন্তু তিনি অর্ধেক খরচ বহন করতে রাজি হলেন কারন ফুল ফান্ডিং করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। অন্যদিকে ফুল ফান্ডিং ছাড়া আমার পক্ষে পড়া সম্ভব ছিল না। কারণ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা খুবই ব্যয়বহুল।

পরপর দু-বার ব্যর্থ হয়ে কিছুটা হতাশ হলেও ফান্ডিং পাওয়ার জন্য নিজেকে আরো বেশি করে ঝালিয়ে নিলাম। অবশেষে, তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় শতভাগ বৃত্তিসহ অক্সফোর্ডে পড়ার সুযোগ পেলাম। আগামী অক্টোবরে আমি স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণ করতে পারব। ভালো মানের একজন বিজ্ঞানী হওয়ার রসদ জোগাড়ে সচেষ্ট থাকব, যেন আগামী বাংলাদেশকে গবেষণা ও বিজ্ঞানজগতে প্রতিনিধিত্ব করতে পারি। কারণ, উন্নত ও অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় গবেষণায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে, যা কোভিড-১৯ মহামারিতে এর তীব্রতা দৃশ্যমান হয়েছে। তাই আগামী দিনে বাংলাদেশ থেকে যেন আরও বেশি শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ড, এমআইটি ও স্ট্যানফোর্ডসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় এবং সেখান থেকে অর্জিত জ্ঞান নিয়ে অনুসরণীয় বাংলাদেশ নির্মাণে অবদান রাখতে পারে, আমার সেই প্রত্যাশাই থাকবে।

এক্ষেত্রে আসলে সুযোগ করে নিতে হবে। এই জন্য থাকতে হবে দৃঢ় অধ্যবসায় ও স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার সফল প্রয়াস। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম যেমন বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’ এই জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই লক্ষ্যকে স্থির রেখে স্বপ্ন দেখা শুরু করতে হবে, আর এক্ষেত্রে বাধা এলে তা দূরে ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সূদৃঢ় প্রত্যয় থাকতে হবে। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে সমাজ ও পরিবারগুলোতে এখনো উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়নি, কিন্তু সময় এসেছে পরিবর্তনের। কারণ, একটি দেশ তখনই উন্নত হয়, যখন উন্নত হয় গবেষণায়। তাই সরকার, সমাজ ও পরিবার সবারই উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা। তাহলে হয়তোবা তাদের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাব ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী, যাদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ও ভবিষ্যৎ।

লেখক:
সায়েন্টিফিক অফিসার ও ইনচার্জ 
বায়োইনফরমেটিকস ডিভিশন
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি 
সাভার, ঢাকা
 

ঢাকা/সাব্বির

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়