ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আর্জেন্টিনাময় তাদের সকাল 

সোয়াদুজ্জামান সোয়াদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪১, ৭ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৮:০১, ৭ জুলাই ২০২১
আর্জেন্টিনাময় তাদের সকাল 

ভোর ৬টা ৪০ মিনিট। বাজারে দোকানদাররা দোকানের শাটার তুলছেন। ঝাড়ু দিচ্ছেন। একে একে বিভিন্ন বয়সের খদ্দের জমছে। কেউ আসছেন চোখ ডলতে ডলতে, কেউবা আবার ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে। নিয়ত একটাই, চা খেয়ে টিভির সামনে বসবেন। আর্জেন্টিনার খেলা দেখবেন।

প্রিয় দল আর্জেন্টিনার বিপক্ষ দলের নামও জানেন না, এমন মানুষও আছেন তাদের ভিড়ে। কারো কাছে হয়তো শুনেছেন আজকে আর্জেন্টিনার খেলা আছে, এতটুকুই যথেষ্ট। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছেন। বাড়িতে যে টিভি নেই, সেটা না। টিভি আছে। কিন্তু একা একা সাউন্ড কমিয়ে দিয়ে খেলা দেখলে ঠিক জমবে না। গোল হলে আওয়াজ দিয়ে বুকে চাপড়াতে হবে, সেজন্যই এক জায়গায় জমায়েত হওয়া। 

তবে একটা দুঃসংবাদ। মানুষ এসেই শুনছেন ডিস এন্টেনা নেই। শুনে মেজাজ হারিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, ‌‌'অয় (ডিস অপারেটর) ব্রাজিলের সাপোর্টার, সেজন্য ডিস দেই নাই।'

ডিস নাই তো বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। ওয়াইফাই ব্যবহার করে মোবাইল ফোনেই খেলা দেখা যায়। কিন্তু আরও একটা দুঃসংবাদ ওয়াইফাইও নেই। তাহলে কি খেলা দেখা হবে না? নিশ্চয়ই হবে। কারণ, ডিস থাকুক না থাকুক আর্জেন্টিনার খেলা, খেলা তো দেখতে হবে। ওয়াজেদ (২০) নামে একটা ছেলে মোবাইলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে খেলা চালু করে একটা বেঞ্চিতে রাখলো। বেঞ্চিটাকে ঘিরে দশ-পনেরো জনের জটলা। ততক্ষণে জাতীয় সংগীত হচ্ছে। একজন পাশ থেকে বললো ওয়াজেদের মোবাইলের ডাটা শেষ হলে সে তার ফোনের ডাটা ব্যবহার করে খেলা দেখাবে। বেশ আমেজের ব্যাপার।

এমন সময় যে দোকানে খেলা দেখা হয়, সেই দোকানদার ডাক দেওয়ার মতো বললের, 'ডিস আসছে, ডিস আসছে।' মোবাইল ঘিরে যে জটলাটা ছিল, তা ভেঙে সবাই সেই দোকানের দিকে ছুট দিলেন। কেউ দোকানের ভেতরে মেজেতে বসলেন, কেউ দোকানের সামনে বেঞ্চিতে। যাদের জায়গা হলো না, তারা দাঁড়িয়ে পড়লেন যুঁত মতো জায়গা করে। যদিও লকডাউন, এতো মানুষ এক জায়গায় জমা হওয়া ঠিক নয়। পুলিশ এসে ঠ্যাং ভেঙে দিতে পারেন। কিন্তু এটা প্রত্যন্ত এলাকা (নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের নয়া বাজার)। পুলিশ আসলেও ১০টার আগে আসবে না। খেলাটা নিশ্চিন্তে শেষ হবে। তবুও তো ভয় থাকেই। হ্যাঁ, আরও একটা ভয় আছে, আর্জেন্টিনা হারলে ব্রাজিলের সমর্থকদের সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ থাকবে না।

খেলা শুরু হয়ে গেলো। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, এখানকার বেশিরভাগ মানুষকেই কখনো বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার সময় টিভির সামনে বসতে দেখি নাই। নিজের দেশ হারলো নাকি জিতলো, সে সমন্ধে কখনো খোঁজ নিয়েছে বলে জানা নেই। অথচ ফুটবলে এত টান, এনারা ক্রিকেটের নিয়ম কানুন জানেন তো?

মেসির পায়ে বল গেলেই একটা উত্তেজনা ভর করে সবার মাঝে। মাথাটা সামান্য ঝুঁকে যায় সামনে, চোখের মনি যেন স্থির হয়। এই বুঝি গোল হলো। হলোই তো, খেলা শুরুর ৭ মিনিটের মাথায় গোল। এক লাফে সবাই যেনো উঠে পড়লো। হাত পায়ের ছোড়াছুড়ি, বুকে বুক মেলানো, বাধ ভাঙা চিৎকার। কে পায় আর তাদের? 

আচ্ছা গোল কে দিল? মেসির এসিস্ট এ লুটারো মার্টিনেজ। কিন্তু গোলদাতা লুটারো মার্টিনেজের নাম কজন উচ্চরণ করতে পারে? ২২ নম্বর জার্সি গোল করেছেন, গোল হয়েছে। ১-০ তে এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা, এটাই আসল। 

এখন কথা উঠল কলোম্বিয়াকে নিয়ে। ওটাও কিন্তু ভালো টিম। গোল শোধবোধ হতে পারে। কিন্তু দুই টিমেই আজকে এত ফাউল খেলছে কেন? একজন বললো, ‌'এটা সেমিফাইনাল বুঝলেন বাহে, পয়েন্টের খেলা নোমায় (নয়)। যায় (যে) জিতবে তায় (সেই) ফাইনালে যাবে। আর হারলে বাড়ি। জীবন যাউক জিতির (জিততে) তো লাগবে। এমনি এইটা বোধায় (বোধ হয়) মেসির শেষ খ্যেলা (খেলা)।' অনেকে আবার মন্তব্য করছেন, একটা গোলে ভরসা নেই। যখন-তখন শোধ হতে পারে। আর একটা গোল দরকার। 

এভাবেই ৪ মিনিটের অতিরিক্ত সময় যুক্ত করে প্রথমার্ধের সমাপ্তি। এখন রুটি-কেক-চা-পান-সিগারেট খাওয়ার সময়। যাদের পকেটে টাকা নেই, তারা উঠে পাশে দাঁড়িয়ে গেলো। একজন খাবে আর একজন দেখবে, বাজে দেখায়, তাই আর কি। কিন্তু ফিরে এসে দেখে আগের জায়গা হারিয়ে ফেলেছে। অন্য কেউ সেই জায়গায় আরাম করে বসেছে। 

দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু। এক সঙ্গে তিনটা খেলোয়াড় পরিবর্তন কলম্বিয়ার। একবারে নতুন করে যেন শুরু করছেন তারা। গোল শোধ করে আরও একটা দিতে হবে এমন প্ল্যান। দোকানে দর্শকের সংখ্যাও বেড়েছে। আর্জেন্টিনা খুব একটা পাত্তা পাচ্ছে না। তাই দর্শকেরাও একটু ঝিমাচ্ছেন। এমন সময় ডি মারিয়াকে বদলি প্লেয়ার হিসেবে নামানো হলো। 

আবার শুরু হলো নানা জনের নানা কথা। 'এইবার খেলা হবে বুঝলি। মেসিকে বল বানায় দিতে পারতেছে না তাই খেলা হচ্ছে না।' এর মধ্যে একজনের প্রশ্ন, আচ্ছা ডি মারিয়ার সমস্যা কি, পুরো সময় খেলায় না কেন? 'আরে ওর দেহা (দেহ) চলে না। শুকান একটা মানুষ এই জন্যে পরে নামায়।' আর একজন বললো, 'ডি মারিয়া যে পজিশনে খেলেন, ওই পজিশনের অনেকগুলা প্লেয়ার এই জন্যে লেটে নামায়।'

কথা বলতে বলতে গোলটা শোধ। লুইস ডিয়াজের চমৎকার একটা গোল। সব কিছু যেন মুড়িয়ে গেলো। অনেকে বলছেন, খেলাটা এবার জমবে। সত্যিই খেলা জমে গেছে নতুন উত্তেজনা ভর করেছে। আর্জেন্টিনা অন্য একটা উচ্ছ্বাস নিয়ে খেলছে। আর ফাউলের পর ফাউল চলছে।

কোচের চিল্লানি যখন টিভিতে শোনা যাচ্ছে, তখন যে যার মতো করে বানিয়ে একেকটা কথা বলছেন। 'চা চাইলো লিটন চা চাইলো'। বাবা, ছেলে, চাচা, তরুণ, জোয়ান, বৃদ্ধ সবাই যেন আজ এক ধাচের মানুষ। সবাই এক। সবাই খেলা প্রেমী। যে মানুষটা খেলতে দেখলে বকা দেয়, ‘সময় অসময় নাই তোদের শুধু খেলা খেলা আর খেলা, এই খেলা তোদের নষ্ট করবে।’ সেই লোকটা পাশে বসে উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। এটাই ফুটবল। ঝগড়াঝাঁটি হয়ে কথা বলাবলি বন্ধ মানুষটাকে গোল হলে জড়িয়ে ধরা, এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য। 

কিন্তু শেষে তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ খেলা গড়ালো টাইব্রেকারে। পেলান্টি শট হবে। প্রথমে কলম্বিয়ার হয়ে জুয়ান চোদাডো শট নেবে; আর্জেন্টিনার গোলকিপার ডি মার্টিনেজ। গোল হয়ে গেলো। যে দিকে শট, সে দিকেই লাফ দিয়েছেন মার্টিনেজ। 

এবারে আর্জেন্টিনার হয়ে শট নিতে কে আসছেন? এই নিয়ে চলছে চুল ছেড়াছেড়ি। ‘মেসি এলায় (এখন) আসবে না। ২-৩ টা শটের পর আসবে। মেসি পরে আসি কি হবে, আগের গুলা যদি আটকায়।’ কিন্তু জাদুকর মেসি এ আসল প্রথম শট নিতে। কলম্বিয়ার গোলকিপার ডি. অসপিনা। একজন বলল, ‘হাতের মুষ্টি গুলা সবাই ছাড়ি দে। দে দে দে, বল যেন না আটকে।’ হাতের মুঠি ছেড়ে দেওয়ায় যেন গোল কিপারকে ভেলকি লাগায় গোল দিল মেসি। ফলাফল প্রথম শটে ১-১।

কলম্বিয়ার পরের শট আর্জেন্টিনার গোলকিপার মার্টিনেজ আটকিয়ে দিলো। আর আর্জেন্টিনার হয়ে শট নিতে আসা ডি পাউল গোল পোস্টের উপর দিয়ে মারল। ১-১ গোলের সমতা। ‘এয় যে চৌখে (চোখে) দেখে না? এরে কায় (কে) মারির দিছে? এত্তটা গোলবার ওয় বাইরোত (বাইরে) সটায় (শট নেয়)। ’ 

৩ নম্বর কিকে আর্জেন্টিনার গোলকিপার মার্টিনেজ হাতে মুখে লাগায় কোনো মতে ঠেকিয়েছে। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়ের শর্টে গোল। তিন শটে ১-২ এ আর্জেন্টিনা এগিয়ে।

পরের শটে কলম্বিয়ার গোল। আর্জেন্টিনার ও গোল। ৪ শটে দাঁড়ালো ২-৩; আর্জেন্টিনা এখনো এগিয়ে। শেষ শট কলম্বিয়ার যদি গোল হয় আর আর্জেন্টিনার না হয়, তাহলে আবার ড্র। ৩টা করে শট নেবে আবার। ‘আরে ডি মারিয়া এখন সটায় নাই, ওর টাতে ম্যাচ জিতবে।’

কিন্তু মার্টিনেজ ৫নং শটটাও আটকিয়ে দিলো। সেইসঙ্গে এক লাফে সবাই ঝাঁপিয়ে উঠলো। ব্রাজিলের সাথে ফাইনাল। আহা সেটাই হবে ম্যাচ। একজন বললেন, ‘বাঘের বাচ্চা গুলকি (গোলকিপার) মার্টিনেজ। একবারে কাঁকড়া। ৩টা শট আটকাইছে।’খেলা শেষ, বুকভরা প্রশান্তি নিয়ে সবাই সবার মতো কাজে বেরিয়ে পড়লেন। 

লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

হাবিপ্রবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়