ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

দুই যুগে গণ বিশ্ববিদ্যালয়

অনিক আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২০, ১৪ জুলাই ২০২১  
দুই যুগে গণ বিশ্ববিদ্যালয়

৩১ একরের ছোট্ট ক্যাম্পাস, কিন্তু হাজারো শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার গড়ার মাধ্যম। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের লাখো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন নিভে যাওয়ার শঙ্কা থাকে শুধু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে। এসব শিক্ষার্থীর কথা বিবেচনা করে, তাদের ভবিষ্যতকে সুন্দর পরিণতি দিতে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সাভারে গড়ে ওঠে একটি প্রতিষ্ঠান-গণ বিশ্ববিদ্যালয়। 

এই প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। আজ ১৪ জুলাই, ২০২১। দুই যুগে পদার্পণ করেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

রাজধানীর অদূরে সাভার উপজেলার নলাম গ্রামে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠন ও দেশের বিদ্যমান দারিদ্র্যতার বিপরীতে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এ প্রতিষ্ঠান। 

যাত্রার শুরু থেকেই সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তারই অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে অত্যন্ত কম, যা অন্যান্য বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করলে সহজেই বুঝা যায়। তবে টিউশন ফি কম হলেও শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য কোনো সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গ্রাম ও শহুরে আবহের মিশেলে গড়া প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে ‘উ’ আকৃতির বিশাল একাডেমিক ভবন। বর্তমানে এখানে ৪টি অনুষদের অধীন ১৪টি বিভাগ চালু রয়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি মাস্টার্স কোর্সও চালু আছে।

শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহায়তার জন্য যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বিষয়ভিত্তিক হাজারো বই সমৃদ্ধ সুবিশাল গ্রন্থাগার, আধুনিক উপকরণ সমৃদ্ধ পরীক্ষাগার, এজলাস, ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা ইত্যাদি সবই রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে ভূমিকা পালন করে চলেছে সর্বশেষ চালু হওয়া ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস অনুষদ। ২০১৬ সালের মে মাসে চালু হওয়া বিভাগটি বর্তমানে দেশের প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এখানেই পড়ানো হয়। অন্যান্য বিভাগের সাথে তাল মিলিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রেও দারুণ গতিতে এগিয়ে চলেছে নব্য প্রতিষ্ঠিত এই অনুষদ।

ভেটেরিনারি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুবিধাদির সিংহভাগই প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে কর্তৃপক্ষ। ভেটেরিনারি ছাড়াও মেডিক্যাল ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের মতো বিরল বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী পরিচয়। পূর্বেও বিভিন্ন বিষয়ে ব্যতিক্রম কিছু করে সুনাম অর্জন করা গণ বিশ্ববিদ্যালয় বছর তিনেক আগে দারুণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তথা হিজড়াদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে প্রশাসন। নিয়োগের পূর্বে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চার সদস্যের একটি টিম।

নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও ব্যতিক্রমী হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলায় অংশ নিলে ২৫ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফের সুযোগ রয়েছে। এতে নারী শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করছে এবং প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বড় বড় টুর্নামেন্ট জয় করছে।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যতিক্রমধর্মী আরেক পরিচয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। দেশের প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শুধু এখানেই রয়েছে ছাত্র সংসদ।  দুই বছর পরপর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। এমনিতে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চায়ও শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণে কাজ করে চলেছে ছাত্র সংসদ। 

দেশের প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সংগঠন হিসেবে ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (গবিসাস)। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করে যাওয়া গবিসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

সংগঠন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় দারুণ ভূমিকা রাখে। ক্যাম্পাসে বর্তমানে প্রায় বিশটি সংগঠন রয়েছে। এদের মধ্যে বেশকিছু সংগঠন সত্যিকার অর্থেই প্রশংসনীয় কাজ করছে। রক্তদাতা সংগঠন বৃন্ত, ডা. এড্রিক বেকার ব্লাড ফাউন্ডেশন, সাংস্কৃতিক সংগঠন অগ্নিসেতু, ডিবেটিং সোসাইটি, সাধারণ ছাত্র পরিষদ, মিউজিক কমিউনিটি, কালেরকন্ঠ শুভসংঘ, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারসহ সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ কাজ করার চেষ্টা করছে।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গৌরবময় অর্জন তথা সাফল্যের ক্ষেত্রে খেলাধুলার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।  শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় ফুটবল ও ক্রিকেট মাঠ, বাস্কেটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ও টেনিস কোর্ট।

সরকারের খেলাধুলার প্রতি গুরুত্বের দিকটাকে সম্মান জানিয়ে এখানে পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রীড়াক্ষেত্রকে আলাদাভাবে স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছরে দুইবার ক্রীড়া উৎসবে মেতে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, ভলিবল, বাস্কেটবলসহ নানা ইভেন্টে আন্তঃবিভাগীয় টুর্নামেন্ট হয়।

ধারাবাহিকভাবে খেলাধুলাকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার পুরস্কারও পেতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালের মার্চ-এপ্রিলে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৬৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্প। এতে মোট ১০টি ইভেন্টের সাতটিতে অংশগ্রহণ করে চারটিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে গণ বিশ্ববিদ্যালয়। ইভেন্ট চারটি ছিল মেয়েদের ফুটবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল ও ছেলেদের ফুটবল।

প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ফুটবল স্টেডিয়ামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয়ীদের নিজ হাতে পুরস্কার প্রদান করেন। এছাড়া ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত ফারাজ গোল্ডকাপ ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ন হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই নয়, জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়াক্ষেত্রেও অবদান রাখছে এখানকার খেলোয়াড়েরা। বাংলাদেশ জাতীয় প্রমীলা ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাঁতুন, জাতীয় প্রমীলা হ্যান্ডবল দলের তারকা খেলোয়াড় ছন্দা রানী সরকার গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিষ্কার। এছাড়াও আরও বেশ কিছু খেলোয়াড় রয়েছে, যাদের গর্ব করার মতো ক্রীড়া নৈপুণ্য রয়েছে।

বিভিন্ন উদ্ভাবনেও পিছিয়ে নেই প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালের শেষের দিকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের (সিএসই) শেষ বর্ষের ৬ শিক্ষার্থী উদ্ভাবন করেন রোবট ‘মিরা’। বিভাগ থেকে দেওয়া প্রজেক্টের অংশ হিসেবে উদ্ভাবনকৃত এই রোবট দেশের নামকরা টেলিভিশন, পত্রিকা, ম্যাগাজিনে ফলাও করে প্রচার হয়। মিরা ছাড়াও উদ্ভাবন করা হয় নার্স রোবট 'অ্যাভওয়্যার' ও অন্ধ ব্যক্তিদের পথচলায় সহায়ক ব্লাইন্ড স্টিক।

উদ্ভাবনের নেশা তবুও থেমে থাকেনি। গত বছরের মার্চে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের ঘোষণা দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ঘোষণা অনুযায়ী নানা বাধা পেরিয়ে করোনা টেস্টিং কিট উদ্ভাবন করে তারা। 

এই উদ্ভাবক টিমের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল। মাত্র ৫ মিনিটে ফলদায়ক এই কিট করোনার সার্বিক পরিস্থিতি নির্ধারণে দারুণ ভূমিকা রাখে। যদিও সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও এই কিটের অনুমোদন মেলেনি।

এমনই নানা উদ্ভাবনের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে গণ বিশ্ববিদ্যালয়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এমন দুর্বার গতিতে পথচলা সামনে আরও ভালো কিছুরই ইঙ্গিত দেয়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আরও এগিয়ে যাবে প্রাণের ক্যাম্পাস। সমৃদ্ধ হবে অর্জনের ভান্ডার, এগিয়ে যাবে দেশ। দুই যুগে পদার্পণকালে এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার চাওয়া।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

গবি/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়