ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চতুষ্কোণ: মনস্তাত্বিক লড়াইয়ের আড়ালে অদৃশ্য ভালোবাসা

ইমানুল সোহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ৩১ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৭:২০, ৩১ জুলাই ২০২১
চতুষ্কোণ: মনস্তাত্বিক লড়াইয়ের আড়ালে অদৃশ্য ভালোবাসা

ইমানুল সোহান

ব্যক্তি ভেদে ভালোবাসায় ভিন্নতা রয়েছে। ভালোবাসার সংজ্ঞায়ন করাটা দূরহ ব্যাপার। বৈচিত্রময় জগতে অবচেতন মনে মানুষ অনেক কিছুকে ভালোবাসে।  সকালে কারও ইবাদত করা, কারও আবার চায়ের সাথে পত্রিকা পড়া, কারও বই পড়া, কারও আবার বাগান পরিচর্যা করাটাই ভালোবাসা। রোজকার জীবনে হয়তো তাদের ভালোবাসার ধরনটাই এরকম। শুধু যে একজন পুরুষ কিংবা একজন নারীর প্রতি যে ভালোবাসা তাই শ্রেষ্ঠ। এটা ব্যক্তি ভেদে পরিবর্তন সাধিত হয়। তবে জগৎজুড়ে মানব- মানবীর মাঝে সৃষ্ট ভালোবাসা সেটাই শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা। কারণ পৃথিবীর সব আয়োজন মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে থাকে।

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আমরা অনেক মাত্রা থেকেই ভালোবাসা নামক অনুভূতিটি অনুভব করি। কিন্তু এর বেশিরভাগ ভালোবাসাই হয়তো আমরা অনুভব করি নিজেদের অজান্তে, আমাদের অবচেতন মনে। ভালোবাসা ছাড়া মানুষের জীবন হয়তো হয়ে থাকতো বর্ণহীন, স্বাদহীন।

কবি - সাহিত্যিকদের লেখায় ভালোবাসার মাত্রাগুলো সময় বিবেচনায় ধরন পাল্টিয়েছে। সেদিক বিবেচনায় জীবনানন্দ দাসের কথাই ধরুন। জীবন সংগ্রামী এই লোকটি বন্ধুদের তিরষ্কারে সাহিত্যজগতে পা রেখে সবাইকে চমকে দিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীজুড়ে মানবিক মূল্যবোধের যে চরম সংকট দেখা দিয়েছিল, তারই প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলা কথা-সাহিত্যে আমূল পরিবর্তনের এক ধারা সূচিত হয়। যে কয়েকজন লেখকের হাতে এ বৈপ্লবিক ধারার সূচনা হয় মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রিয়ালিটি বা জীবনবাদী শিল্পী। কারণ সম-সাময়িক কালের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের ট্রাজেডি, এত নির্মম বাস্তবতা ও শিল্প-কুশলতায় আর কোনো লেখক ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। নিম্নবিত্ত ও সর্বহারা সমাজের মানুষের ক্ষয়-ক্ষতি, মনুষ্যত্বের অপচয়, ক্লেদ-হতাশা ও দুঃখ বেদনায় তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্রধারায় চিরভাস্বর।

বিষয়বস্তু ও মনোদৃষ্টির ভিন্নতার কারণে তার রচিত উপন্যাসসমূহকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পুতুল নাচের ইতিকথা এবং পদ্মানদীর মাঝি। দ্বিতীয় ভাগে চতুষ্কোণ সরীসৃপ অহিংসা প্রভৃতি এবং তৃতীয়ভাগে পড়ে শহরতলী চিহ্ন আরোগ্য ইত্যাদি। জীবনাদন্দ দাসের চতুষ্কোণ উপন্যাসটি পড়লে একজন নারীর প্রতি একজন পুরুষের যে ভালোবাসা কিংবা একজন পুরুষের প্রতি একজন নারীর যে ভালোবাসা, তা অনুমেয় করা যাবে। মজার ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ সময় আমরা ভালোবাসার শুধু এই মাত্রাটিকেই সামগ্রিকভাবে ভালোবাসা হিসেবে ধরে নেই। অন্যান্য মাত্রাগুলোও যে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আমাদের জীবনকে বহু রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে, তা আমরা খেয়ালই করি না।

চতুষ্কোণ উপন্যাসটিকে আমি উপলদ্ধি থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। উপন্যাসের শুরুতেই লেখক রাজকুমারকে মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত করে তুলে ধরা হয়েছে। বলে রাখা ভালো, উপন্যাসের পুরুষ কেন্দ্রীয় প্রধান চরিত্র রাজকুমার। এছাড়াও পুরুষ পাশ্বচরিত্র হিসেবে শ্যামলকে দেখতে পাওয়া যায়।  নারী চরিত্র হিসেবে রিনি, সরসী, গিরি, মালতী ও কালী রয়েছে।

উপন্যাসে কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র রাজু থাকে আপন চিন্তার জগতে। আপন মনে সে চিন্তা করে বিভিন্ন বিষয়ে, উত্তর খুঁজে বেড়ায় বিভিন্ন সামাজিক ও জাগতিক প্রশ্নের। রাজুর বিভিন্ন সূত্রে পরিচিত চারজন মেয়ে রিণি, মালতী, সরসী এবং কালি। চারজনই সুদর্শন রাজুর প্রেমে পড়ে। কিন্তু রাজু যেন তার মনে তাদের কারো জন্য প্রেমবোধ করে না। ফলে সে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে সামনের করণীয় নিয়ে। এদিকে একেকজনের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ একেক রকমের। কিন্তু রাজুর ভাবুক মন জানতে চায় কোন তাড়নায় একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে। ভালোবাসার টানা-পোড়েনে একসময় তার সাথে একে একে সবার সম্পর্কের তিক্ততা সৃষ্টি হতে শুরু করে।

প্রথম ভাগে রাজকুমারের মানসিক যুদ্ধ তথা তিক্ততা শুরু হয় গিরির নাড়ী পরীক্ষা করতে গিয়ে। গিরির অপ্রস্তুত অবস্থাতেও যখন রাজকুমার নাড়ী পরীক্ষা করে। তখন গিরি ঘটনাটি তার মাকে গিয়ে বলে। তখনি ঘটে বিপত্তি। এ ঘটনাটি রাজকুমার তুচ্ছভাবে নিলেও গিরি ও তার মা সহজভাবে নেয়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে রাজকুমারের মনে সন্দেহের আবেশ সৃষ্টি হয়। তখনি রাজকুমার নারীদের অনাবৃত শরীরের তত্ব খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

গিরির পরে রাজ রিনির কাছে যায়। উপন্যাসের মূল নারী চরিত্র হিসেবে যাকে বিবেচনা করা যেতে পারে। রাজকুমারের চুম্বন আহবান রিনি হেলায় ফিরিয়ে দেয়। ফলে সেখানেও ব্যর্থ হয় রাজকুমার। রাজকুমার নিজের তত্ত্বের সমাধান শুধু খুঁজতে চায়। এখানে যৌনতা বলে কিছু নেই। কিন্তু নারী চরিত্রগুলোর কাছে রাজুর এ চাহিদা শুধুই যৌনতা হিসেবে দেখা দেয়। ফলে গিরির ঘটনার পর রাজুর কৌতুহলী মনের যে আকাঙ্ক্ষা রিনির কাছেও তা আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়।

তবে অন্য যে কোনো মেয়ের চেয়ে সরসী রাজকুমারকে একটু বেশিই বুঝতে পারে বলে রাজকুমারের ধারণা ছিল। সে সরসীর সাথে খুব সহজেই অনেক কথা বলতে পারতো, যা মালতী বা রিনির সাথে বলা যেত না। সরসী রিনির কাছে রাজকুমারের অনুরোধের কথা জানতে পেরে রাজকুমারের সাথে কথা বলে। রাজকুমার তাকে জানায়, সে শুধু তার তত্ত্বের সমাধান খুঁজছে কিন্তু সরসী তাকে বলে ‌‘দেহের গড়নের সঙ্গে মানুষের প্রকৃতির সম্পর্ক কি তাই টেস্ট করার জন্য কেউ এভাবে ব্যাকুল হয়? তোমার আরো সিরিয়াস কিছু হয়েছে, এশুধু তার একটা লক্ষণ।’

অবশেষে, সরসী রাজকুমারের তত্বের সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্যের জন্য স্বেচ্ছায় রাজুদার সামনে এসে নিজের অনাবৃত দেহ প্রদর্শন করে। রাজকুমার তার তত্ত্বের ব্যাখ্যা খুঁজে পায়। কিছু দিনের জন্য নিজের মনের মধ্যে জমে থাকা অপরাধ বোধ প্রশমিত হয়।

দ্বিতীয়ত সরসীর অনাবৃত দেহ দেখার পরেও রাজকুমারের তত্ত্বের সমাধান শেষ হয়নি। রাজকুমার মালতীর মাঝে তা খুঁজতে চাই। একদিন মালতী সিনেমা দেখবে বলে শ্যামলকে ডাকে। পরক্ষণেই তার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন সাধিত হয়। রাজকুমারকে ফোনে মালতী জানায়, আজ সন্ধ্যাটুকু তোমার সাথে কাটাতে চাই। কথা মোতাবেক মালতী ও রাজকুমার ঘুরতে বের হয়। একপর্যায়ে তারা রাত্রে হোটেলে থাকবে বলে ঠিক করে। কথা অনুযায়ী তারা হোটেল ঠিক করে। কিন্তু কাজের চাপে সময়মতো রাজকুমার মালতীর কাছে যেতে পারেনি। কিছু সময় পর রাজকুমার মালতীর গৃহে উপস্থিত হয়। রাজু মালতীর কাছে বিশেষ কিছু আশা করে। কিন্তু মালতী শরীর অসুস্থতার কথা বলে এড়িয়ে যায়। কারন মালতী এভাবে রাজকুমারকে পেতে চায় না। দু'জনের কথোপকথনের এক পর্যায়ে মালতী বলে, ‘এক রাত্রির জন্য রুম নিয়ে নয়, চলো আমরা কোথাও চলে যাই দু'জনে মাস তিনেকের জন্য। অন্তঃত দু'মাস।’

মালতীর এ আকুতি রাজকুমারকে শুধু নিজের করে পাওয়ার জন্য। কিন্তু রাজকুমার তো কাউকে মন থেকে ভালোবাসে না। তার তত্ত্বের সমাধানের জন্যই সে চারজনের কাছে ছুটে যায়। কালী, সরসী রিনি কিংবা মালতী এই চার নারী চরিত্র নিজ নিজ অবস্থান থেকে রাজকুমারকে পেতে চায়।তবে রাজুর মনে অবচেতন প্রক্রিয়ায় চারজনের অবস্থান সমান।

রাজকুমার চরিত্রটা সম্ভবত মানিকের সবচেয়ে জটিলগুলোর একটি। শুধু মানিক কেন, বাংলা সাহিত্যের আর কোনো লেখক এমন প্রহেলিকাময় কোনো চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন কি না সেই প্রশ্ন রেখে যাওয়া যায়। সে একই সাথে যৌনতাড়িত, আবার কখনো কখনো একেবারেই শরীরবিমুখ। সে সবসময় যুক্তির কষ্টিপাথরে সবকিছু যাচাই করে নিতে চায়, আবার রিনির পরিণতির জন্য খানিকটা অযৌক্তিকভাবেই নিজেকে কাঠগড়ায় তুলতে দ্বিধা করে না। তার মানে কি তাঁর যুক্তিবাদী মনের আড়ালে একটা আবেগী স্বত্বা আছে?

হয়তো আছে বলা যায়। নয়তো অনেকদিন পর রিনির খোঁজ করতে গিয়ে তার অসুখের খবর শুনে রাজু হতাশাগ্রস্ত হয়।  সংগীতপটীয়সী পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একজন নারীর কাছ থেকে রাজকুমার কী চায়? রিনির চুম্বন আহবান যেমন সে হেলায় ফিরিয়ে দেয়, আবার বিকারগ্রস্ত সেই রিনির কাছেই সে নিজেকে সমর্পণ করে। আবার সেই রিনির কাছেই সে কোনো বিচিত্র কারণে খাপছাড়া (আসলে অবিশ্বাস্যই বলা উচিত) এক আবদার করে বসে। সেটা এমনই অদ্ভুত, রিনি সে ধাক্কায় অনেকটাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সুস্থ রিনি যেমন রাজকুমারকে দূরে ঠেলে দিত, অসুস্থ রিণি তাঁকে প্রাণপণে কাছে পেতে চায়। তার মানে কি রিণির অবচেতন মনের ইচ্ছাটাই এটা ছিল? মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা রিনি রাজকুমারকে কাছে পেলেই শান্ত হয়ে যায়। যত পাগলামি রাজকুমার না থাকলে শুরু হয়। দেখুন ভারসাম্য হারিয়ে অনাবৃত শরীরে থাকা রিনিকে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দেয় রাজু। তবে কী রাজু অবচেতন মনেই রিনিকে ভালোবেসে ফেলেছে? নাকি বিকারগ্রস্ত হওয়ার কারণে সহানুভূতি দেখিয়ে কাছে গেছে। আমার মতে, রাজু সচেতন মনেই রিনিকে ভালোবেসে ফেলেছে।

উপন্যাসের শেষ দিকে রিনিকে বিবাহ করতে সদিচ্ছা পোষণ করে রাজু। এতে সরসী সম্মতি পোষণ করে। মজার ব্যাপার হলো এ উপন্যাসের সবচেয়ে সেরা চরিত্র বলা যেতে পারে সরসীকে। যে রাজুকে তত্ত্ব সমাধানের পথে এগিয়ে দেয় আবার রিনিকে রাজুর হতে সহযোগিতাও করে। মনস্তাাত্ত্বিক লড়াইয়ের এই হলো রাজুর অদৃশ্য ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

যৌন চাহিদা ভালোবাসার একটি অংশমাত্র, কিন্তু যৌন চাহিদা ছাড়াও ভালোবাসায় আরও অনেক চাহিদা থাকে। শুধু নিজেদের যৌন চাহিদা পূরণের জন্যই একজন মানব আর একজন মানবী ভালোবাসার বন্ধনে আবধ্য হয় না। যদি তাই হতো, তাহলে রাজু কখনোই মানসিক বৈকল্যগ্রস্ত রিণিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো না আবার যৌনতার গুরুত্ব একেবারেই না থাকলে রাজু একটি তত্ত্বের উত্তর খুঁজতে নারীর অনাবৃত দেহ দর্শনের ইচ্ছায় ব্যাকুল হয়ে পড়তো না। ভালোবাসা যৌন চাহিদা ও জাগতিক চাহিদার এক জটিল ও অদ্ভুত মেলবন্ধন বলা চলে।

শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

ইবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়