ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শিক্ষা পুনরুদ্ধারের প্রাণই শিক্ষক  

সাইফুল ইসলাম তালুকদার (রনি)  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৫, ৫ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১২:৪৯, ৫ অক্টোবর ২০২১
শিক্ষা পুনরুদ্ধারের প্রাণই শিক্ষক  

আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষা উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদান স্বীকৃতি দিতে ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে, ইউনেস্কো প্রতি বছর একটি স্লোগান প্রকাশ করে থাকে। এবাবের স্লোগান ‘শিক্ষা পুনরুদ্ধারের প্রাণই হলো শিক্ষক’। স্লোগানটির মর্মার্থ যত দ্রুত উপলব্ধি হবে, শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সফলতা তত দ্রুতই অর্জন করা যাবে। 

করোনার কারণে গত বছর ১৭ মার্চ বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হলে প্রায় ৫৪৪ দিন পর গত ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়গুলো খোলা হয়েছে। ফলে শিক্ষা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ শিক্ষার রূপরেখা তৈরি করার এখনই সেরা সময়। ভবিষ্যৎ শিক্ষার রূপকল্প প্রস্তুত করার জন্য শিক্ষকরাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য আমাদের এই মূহূর্তে যে বিষয়গুলো আলোচনা করা দরকার, তা হচ্ছে-  

শিক্ষকতার পেশার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা

‘আলোকিত টিচার্স’ গত মাসে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য একটি সার্ভে করেছিল। সেখানে শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, শিক্ষকরা কি তাদের পেশাটিকে নিরাপদ মনে করেন? ২৫ শতাংশ শিক্ষকই সন্তুষ্টজনক মন্তব্য করেননি। তাদের এই নেতিবাচক মন্তব্যের পেছনে যুক্তিগুলোও আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অনেকেই করোনার কারণে  বিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে জীবিকার জন্য অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। 

পত্র-পত্রিকা থেকে জানা যায়, করোনাকালীন সময়ে প্রায় ১০ হাজার কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। শিক্ষকতা পেশার নিরাপত্তা না থাকার ফলে আগামীতে শিক্ষকতা পেশায় অনেক মেধাবীই আসতে চাইবে না। আমাদের এখনই সময় এসেছে, এই পেশার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিক্ষকেরা আগামীতেও যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন বীমা, বিশেষ ঋণ সহায়তা দিয়ে পেশার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন সুনির্দিষ্ট করে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। শিক্ষকেরা জেনো বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে তা ভাবতে হবে। সময়ের সাথে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের বেতনের মানদণ্ড মানসম্মত করতে হবে।  

আগ্রহীদেরই শিক্ষকতায় নেওয়া দরকার

শিক্ষা সময়ের সেরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সাসটেনবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা স্থায়ী উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ভারতের নোবেল জয়ী শিক্ষাবিদ কৈলাশ সত্যার্থী বলেন, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুণ রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পেশায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে। 
  
শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পৃথিবী প্রতি সেকেন্ডে বদলে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে শিক্ষকদেরও বদলাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একজন শিক্ষক আজকেই আগামী দশকের সময়, সুযোগ ও সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করছে। ফলে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের আত্মোন্নয়নের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিতে হবে। আলোকিত টিচার্সের গত মাসের জরিপে শিক্ষকদের একটি প্রশ্ন করেছিল, শিক্ষকেরা তাদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন মনে করেন কিনা? ৮৬.৭ শতাংশ শিক্ষকই মনে করেন তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের দরকার। করোনার মতো যেকোনো মহামারি মোকাবিলায় শিক্ষকদের পূর্ব প্রস্তুত করে রাখতে হবে, তার জন্য প্রশিক্ষণ খুব দরকার। করোনার সময়ও কিভাবে শিক্ষাকে পুনরুদ্ধার করা যায় তা নিয়ে জ্ঞান রাখতে হবে। 

আলোকিত টিচার্স সবসময়ই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ ও এককভাবে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে বসে শিক্ষকেরা লাইভ ক্লাসে অংশ নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। অনেকেই শিক্ষণ-শিখন উন্নয়নের জন্য লাইভ কোর্সগুলো (alokitoteachers.com) -এ ওয়েবসাইটে গিয়ে খুব কম সময়ে হাতে-কলমে শেখেন।  

শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উপাদান হল শিক্ষার্থী, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল শিক্ষক। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও অভিভাবকের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক সফলতা পেতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। করোনাকালীন সময় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘসময় বাড়িতে অবস্থান করায় শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মানসিকভাবে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে শিক্ষকেরা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকবেন। ফলে অভিভাবকেরা শিক্ষকদের সহযোগিতা করবেন। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, আন্তরিকতা ও আস্থার জায়গা তৈরি করতে শিক্ষক-অভিভাবক যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে প্রচেষ্টা চালাবেন। 

শিক্ষকতা হোক আনন্দদায়ক

শিক্ষা হোক আনন্দদায়ক এটা সবার প্রত্যাশা। কিন্ত শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করার জন্য আমরা সবসময়ই শিক্ষার্থীর কথা বিবেচনা করি। আমাদের শিক্ষার পাঠ্যক্রমেও শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের চাপ কমানোর জন্য নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমাদের ভাবতে হবে, শিক্ষকদেরও চাপমুক্ত রাখতে হবে। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অনেক জরীপ কাজে অংশ নিতে হয়। অন্যান্য শিক্ষককে শিক্ষণের পাশাপাশি অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন- বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাও একজন শিক্ষককে দেখতে হয়। একজন শিক্ষককেই প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ,ফাইলপত্র নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয়। ফলে, শিক্ষক তার মূল কাজ শিক্ষণ থেকে অনেক সময়ই বিচ্যুত হয়ে যান। শিক্ষকদের চাপমুক্ত রেখে শিক্ষাদান ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের বিভিন্ন রিক্রেয়শন লিভের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধির জন্য বিদ্যালয় থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 

শিক্ষকদের স্বীকৃতি দেওয়া

শিক্ষকতায় স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। ফলে শিক্ষকদের প্রতিটি কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করা। ইদানিং অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষকদের কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে থাকে। যেমন- বছর শেষে ‘সেরা শিক্ষক’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই বছর সরকার এটুআই ও গ্রামীণফোনের উদ্যাগে ‘সংকটে নেতৃত্বে’ শিরোনামে শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করেছে। এছাড়া আলোকিত টিচার্স ‘টিচার্স ইনোভেটরস-২০২১’ এর মাধ্যমে শিক্ষকদের উদ্ভাবনগুলোর স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সারা বাংলাদেশের সব শিক্ষক থেকে আসা ইনোভেশনগুলোর মধ্যে সেরা তিনজনকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। এভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষকদের উদ্ভাবন এবং কাজের স্বীকৃতি প্রদান করতে পারে।     

আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে তার প্রতিচ্ছবি হলো আজকের শিক্ষকেরা। শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ব্যতিত শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন হবে না। ফলে শিক্ষকের দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাধীনতা ও সম্মানের বিষয়ে যত্নশীল হওয়ার মাধ্যমেই আগামীর স্বনির্ভর ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব।  

লেখক: প্রশিক্ষক, আলোকিত টিচার্স এবং এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অফিসার, আলোকিত হৃদয় ফাউন্ডেশন।

/মাহি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়