ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অধ্যাপক শামীমা যেভাবে হয়ে ওঠেন ‘ক্যাম্পাস জননী’ 

আশরাফ আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ৫ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১২:২৬, ৫ ডিসেম্বর ২০২১
অধ্যাপক শামীমা যেভাবে হয়ে ওঠেন ‘ক্যাম্পাস জননী’ 

অধ্যাপক শামীমা আখতার চৌধুরী

শ্রেণিকক্ষের বাইরেও ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করতে চায়, আমি মন দিয়ে তাদের সমস্যাগুলো শুনি। ওরা প্রাণখুলে কথা বলে। আমি সমাধানের চেষ্টা করি। শিক্ষার্থীরা আমার সন্তানের মতো। তাদের সাথে কাটানো সময়গুলো বরাবরই চমৎকার লাগে, মুখে একঝলক রূপালি হাসির রেখা টেনে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক শামীমা। 

পুরো নাম অধ্যাপক শামীমা আখতার চৌধুরী। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে ১৯৬২ সালের ৫ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া অধ্যাপকের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা সিলেট শহরের জিন্দাবাজার এলাকায়।

প্রথিতযশা আইনজীবী বাবা মরহুম জয়নুল আবেদীন চৌধুরীর দুই মেয়ের মধ্যে শামীমা আখতার চৌধুরী বড়। মা মরহুম ফাতেমা আবেদীন চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী। স্বামী মরহুম শোয়েব আহমদ নিজাম ছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স সিলেটের ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার। অধ্যাপক শামীমার একমাত্র ছেলে নাভিদ ইবতেহাজ নিজাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক (বর্তমানে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে ইউএসএতে পিএইচডি অধ্যয়নরত)।

পুরো সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব শামীমা এই জনপদের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কথাকলি’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আবৃত্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘দ্বৈতস্বর’-এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা শামীমা ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ সিলেট শাখার প্রতিষ্ঠাতা সংগঠকও ছিলেন। শিক্ষা জীবনে ভালো বিতার্কিত ছিলেন তিনি। সিলেটের প্রথম বিতর্ক সংগঠন ‘সিলেট ডিবেটিং সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন সিলেটের প্রাক্তন জেলা কমিশনারের দায়িত্বও সুনামের সাথেই পালন করা এই শিক্ষক সিলেট বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। 

বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের ‘ক’ বিশেষ শ্রেণির সংবাদপাঠক এবং বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের ‘খ’ শ্রেণির আবৃত্তিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অসাধারণ বাচনভঙ্গির অধিকারী অধ্যাপক শামীমা সিলেট রেডিওতেও নিয়মিত সংবাদ পাঠক হিসেবে কাজ করেছেন। 

অষ্টম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৯ সালের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষা ক্যাডারে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন৷শিক্ষকতা করলেও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কাজের জন্য সিলেট তথা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা তার। বহুমুখী গুণের অধিকারী এই শিক্ষকের তুলনা তিনি নিজেই। 

এমসি কলেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর শামীমা বর্তমানে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিলেটের ঐতিহবাহী এমসি কলেজে থাকাকালে ক্যাম্পাসটিতে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটান গুণী এই শিক্ষক। এমসি কলেজের একমাত্র নাট্যসংগঠন ‘থিয়েটার মুরারিচাঁদের’ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা শামীমা শতবর্ষী ক্যাম্পাসটির অন্যান্য সংগঠন যেমন—মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ, হবিগঞ্জ জেলা ছাত্র সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের অগ্রভাগে থেকে কাজ করেছেন। ফলে এসময় তিনি কলেজের অন্যতম প্রিয়মুখ হয়ে ওঠেন। 

ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত অধ্যাপক শামীমা শুধু কলেজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেরই প্রিয়মুখ নন, শিক্ষার্থীসহ সবার সাথে চমৎকার ভাবে কথা বলা, ডায়নামিক নেতৃত্ব, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে লুকিয়ে লুকিয়ে সাহায্য করাসহ অন্যসব গুণের অধিকারী এই প্রফেসরের জনপ্রিয়তা সিলেটজুড়েই ছড়িয়ে আছে। 

ক্লাস, ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের মোটিভেট করা, সৃজনশীল কাজে সহযোগিতা করা, সময় নিয়ে কথা শোনাসহ তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয় সবাই। মায়ের মতো আপন মমতায় শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার জন্য এমসি কলেজে থাকাকালীন শিক্ষার্থীরা তাকে ‘ক্যাম্পাস জননী’ বলে ডাকতো। এমসি কলেজ তথা সারা সিলেটে ক্যাম্পাস জননী বলতেই শামীমা চৌধুরীকেই সবাই চেনেন। ধনাঢ্য পরিবারের উচ্চশিক্ষিত মানুষ হয়েও অতি সাধারণভাবেই চলাফেরা করা শামীমার ডায়নামিক নেতৃত্বে বর্তমানে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের চেহারা পাল্টে গেছে। তার প্রতিটি কাজের মধ্যেই সৃজনশীলতায় ভরপুর। 

অসংখ্য গুণের অধিকারী এই প্রফেসর বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে আবৃত্তিতে অবদানের জন্য জেলা শিল্পকলা একাডেমি গুণীজন সম্মাননা ,আবৃত্তিতে অবদানের জন্য ‘উর্বশী পদক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃক ‘নির্ভীক নারী’ পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গুণী এই মানুষ। 

নির্লোভ নিরহংকারী এই শিক্ষকের সংস্পর্শে আসতে এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উৎসাহ অবাক করে সবাইকে। প্রফেসর শামীমার দর্শনে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন পাল্টে গেছে। অনন্য গুণের অধিকারী অধ্যাপকের গ্রহণযোগ্যতা সিলেটের সব সমাজের মানুষের কাছেই আকাশচুম্বী। আপন আলোয় বদলে দেওয়া এমন শিক্ষকের ছোঁয়ায় আলোকিত হোক সমাজ-দেশ। 

১৯৮৯ সালে মহান পেশায় যোগ দেওয়া গুণী এই শিক্ষক ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৩২ বছরের শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে গেছেন। কথা হলে অধ্যাপক শামীমা বলেন, নিজের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করাই তো আসল দেশপ্রেম। একটা সময় আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে। দেহের বিদায় ঘটলেও আমাদের কাজগুলো কিন্তু এই সমাজে থেকে যায়। সবসময়ই চেষ্টা করি বাড়তি কিছু করার। 

গুণী এই শিক্ষক আরও বলেন, আমাদের সবার ইতিবাচক মানসিকতা আর দায়িত্বশীল ভূমিকাই দিতে পারে সুন্দর একটি সমাজ। জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো মানুষের দোয়া, আশির্বাদ ও ভালোবাসা। এগুলো সবার কপালে জোটে না। সেই জায়গায় আমি সৌভাগ্যবান। অসংখ্য মানুষের এই ভালোবাসা আর দোয়ায় থেকেই মরতে চাই। 

লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, এমসি কলেজ।

/মাহি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়