ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

টিফিনের জমানো টাকায় ‘শিশুদের হাসি পাঠাগার’

আব্দুল কাদির, কিশোরগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪১, ৩১ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১৩:৩৫, ৩১ মার্চ ২০২২
টিফিনের জমানো টাকায় ‘শিশুদের হাসি পাঠাগার’

শিশুদের হাসি পাঠাগার, কিশোরগঞ্জ

শিক্ষার্থীরা চাইলে সমাজকে আমূল বদলে দিতে পারেন। তাদের একতার শক্তি আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া একদল কিশোর টিফিনের টাকা জমিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘শিশুদের হাসি পাঠাগার’ নামে একটি লাইব্রেরি৷ 

শুরুটা ২০১৮ সালে। স্কুল ও কলেজের অনেক শিক্ষার্থীর বই পড়ার প্রতি আগ্রহ থাকলেও উপজেলায় কোনো পাবলিক লাইব্রেরি ছিল না। তাদের বই পড়ার প্রতি ইচ্ছা থাকলেও পড়তে পারত না৷এমন সময় নবম শ্রেণি পড়ুয়া মাহমুদুল হক রিয়াদ, আল জাবির ইয়াসিন, মাহফুজুল হক ফাহাদ ও জুনায়েদ রাব্বি প্রকাশের মনে হলো একটা পাবলিক লাইব্রেরি থাকলে পাঠ্য বই ছাড়াও তারা অবসর সময়ে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে পারবে৷ 

সে ভাবনা থেকেই তারা হোসেনপুরে একটি লাইব্রেরি স্থাপন করার কাজ শুরু করেন৷সহপাঠীদের সবাই তাদের উৎসাহিত করেন। এইভাবে তারা পাঠাগারের জন্য সদস্য সংগ্রহ করতে থাকেন। কিছু দিনের মধ্যে ১০০ সদস্য সংগ্রহ করে ফেলেন। সবাই একত্রে সিদ্ধান্ত নেন তাদের টিফিনের টাকা থেকে প্রতিদিন ১ টাকা হারে মাসে ৩০ টাকা চাঁদা দেবেন। কয়েক মাসের টাকা জমিয়ে লাইব্রেরির জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও বই কিনবেন। 

সেসময় রিয়াদ তাদের এই উদ্যোগের কথা জানান কবি ফখরুল হাসানের কাছে। তিনি তার এলাকার শিক্ষার্থীদের এমন আগ্রহ দেখে নিজে ১০০ বই দেন এবং তাদের পাঠাগার স্থাপনের কাজে নানাভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন। 

কয়েক মাস টাকা জমানোর পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দর জীবনের জন্য বই স্লোগান নিয়ে জুনায়েদ রাব্বি প্রকাশের বাসায় শুরু হয় লাইব্রেরির যাত্রা। তাদের জমানো টাকা থেকে একটি বুক সেলফ, ২টি টেবিল, কিছু চেয়ার ও প্রায় ৩০০ বই নিয়ে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু। সদস্যদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে পাঠাগারে বই পড়া ও সর্বোচ্চ ৭ দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে বই পড়ার পদ্ধতি চালু করেন৷

তাদের এই কার্যক্রম ফেসবুকের মাধ্যমে নজরে আসে কিশোরগঞ্জ জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী পরিচালক আজিজুল হক সুমন সাহেবের। তিনি পাঠাগার সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কয়েক দফা কথা বলেন এবং পাঠাগারটি পরিদর্শন করে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করার ঘোষণা দেন। 

এরপর থেকে তাদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি, একে একে তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের এই মহৎ কাজে যুক্ত হতে থাকেন শিক্ষক ও এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। 

২০২০ সালে করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও তারা হটলাইন নম্বরের মাধ্যমে সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পোঁছে দিয়ে উপজেলাজুড়ে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছেন। তাদের কার্যক্রমকে ডিজিটাল করার জন্য তারা ইতোমধ্যে গুগল প্লে স্টোরে একটি অ্যাপস তৈরি করেছেন, যেখানে তাদের সব বইয়ের তালিকা ও বইয়ের জন্য আবেদন করা যায়৷ এ ছাড়াও, নতুন প্রজন্মের মেধাবিকাশের জন্য পাঠাগারের সদস্যরা জাতীয় দিবসগুলোতে রচনা, চিত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে চলছে৷তা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সামাজিক ও মানবিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে উপজেলাজুড়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। 

বর্তমানে পাঠাগারটি হোসেনপুর প্রশিকা অফিসের একটি বড় রুমে অবস্থিত। বইয়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ১টি বুক সেলফ থেকে এখন ৩টি বুক সেলফ। গল্প, উপন্যাস, কাব্য, সায়েন্স ফিকশন, শিশুতোষ ও দেশ-বিদেশের অনেক বইয়ের সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে শিশুদের হাসি পাঠাগার৷ 

প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হক রিয়াদ বলেন, আমাদের উপজেলায় কোনো পাবলিক লাইব্রেরি নাই, স্কুলের লাইব্রেরি সবসময় তালাবদ্ধ। পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের জ্ঞানার্জন। অজানাকে জানার আগ্রহ থেকেই আমরা সবাই মিলে পাঠাগার স্থাপন করেছি৷ 

পাঠাগারের অন্য এক সদস্য শাহরাজ হোসেন রিয়াদ বলেন, অবসর সময়ে মোবাইল ও ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। পাঠাগার স্থাপনের পর আমার অবসরের সময়টাতে সায়েন্স ফিকশন বইয়ের সাথে কাটে। 

পাঠাগারের সহপ্রতিষ্ঠাতা মাহফুজুল হক ফাহাদ বলেন, আমরা এখনো বই সংগ্রহ করছি, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। করোনার সময়ে আমরা হটলাইন নম্বর চালু করি, যার মাধ্যমে সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসছি। এখনো পর্যন্ত যারা আমাদের সদস্য, তারাই শুধু পাঠাগারে বই পড়তে পারছে। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বই ও অবকাঠামো তৈরি করতে পারলে আমাদের পাঠাগারটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেবো৷

লেখক: শিক্ষার্থী, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ।

/মাহি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়