ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দৃষ্টিহীন জসিমের জীবন-সংগ্রাম

ফরহাদ হোসেন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৭, ৪ নভেম্বর ২০২০  
দৃষ্টিহীন জসিমের জীবন-সংগ্রাম

দোকানে ক্রেতার ভিড়। কেউ চা, কেউবা পান-সিগারেট কিনছেন। দোকানিও ব্যস্ত ক্রেতাদের চাহিদামতো পণ্য বিক্রিতে। নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে সেটি বের করে দিচ্ছেন। টাকাও গুনে নিচ্ছেন। কিন্তু তিনি এসব করছেন না দেখে। কারণ, দুই চোখে জসিম উদ্দিন (২৮) কিছু দেখতে পান না। 

দৃষ্টিহীন জসিমের দোকান লক্ষ্মীপুর শহরের উত্তর তেমুহনী বাসস্টেশন এলাকায়। ছোট্ট দোকানে চা, পান, সিগারেট, পাউরুটি, কলা, বিস্কুট বিক্রি করছেন তিনি। নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে দিনভর বিক্রি করে সেই উপার্জনের টাকায় তার সংসার চলে।

ক্রেতা পারভেজ বলেন, দোকানি (জসিম) চোখে দেখেন না। তবুও পণ্যের নাম বললেই কারও সহযোগিতা ছাড়াই তা বের করে দেন। আবার সঠিকভাবে টাকাও গুনে নিচ্ছেন। দৃষ্টিহীন হয়েও কারও কাছে হাত না পেতে ব্যবসা করছেন, এ জন্য সবসময় পান, চা-সিগারেট জসিমের দোকান থেকে কেনেন পারভেজ। 

দরিদ্র পরিবারের সন্তান জসিম উদ্দিন। তিনি সদর উপজেলার চর রুহিতা গ্রামের চা দোকানি শামছুল হকের ছেলে। পাঁচ ভাই-বোনের  মধ্যে তিনি সবার বড়। দৃষ্টিহীন হয়েও তিনি অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে পড়ছেন। 

এক বছর বয়সে জসিমের রক্ত আমাশয় হয়। তৎক্ষণাৎ সন্তানকে নিয়ে গ্রামের চিকিৎসকের কাছে যান তার বাবা। সেখানে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় চোখের আলো হারায় জসিম। এরপর বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসা করালেও চোখের আলো আর ফেরেনি তার। সেই থেকে তিনি দৃষ্টিহীন। 

দুই মাস আগে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসকের দেওয়া অনুদানের অর্থে দোকানের বাক্স কেনেন জসিম। এরপর থেকে উত্তর তেমুহনীর এসএ পরিবহনের কাউন্টারের সামনে চা, পান, সিগারেট বিক্রি করছেন তিনি। বিক্রি ভালো হওয়ায় ক্রমশ জসিমের ব্যবসা বড় হচ্ছে। 

জসিম বলেন, একদিন দালাল বাজার সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুল থেকে শিক্ষার্থী খুঁজতে তার গ্রামে আসেন শিক্ষকরা। তাদের কাছ থেকে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাকার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারেন জসিমের নানা। পরে ওই স্কুলে জসিমকে ভর্তি করান তিনি। ভর্তির পর জসিম বুঝতে শুরু করেন পড়ালেখার গুরুত্ব। প্রতিজ্ঞা করেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের। কিন্তু সেই স্কুলে এসএসসির বেশি পড়ার সুযোগ না থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় তাকে। তাছাড়াও, কলেজের খরচ চালানো সম্ভব না তার দরিদ্র বাবার পক্ষে। তবুও জসিম লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে মোবাইলে রেকর্ড করা পাঠ শুনে এবং একজনের সাহায্যে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে এইচএসসি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স শেষ করেন। বর্তমানে তিনি ওই কলেজে মাস্টার্সে পড়ালেখা করছেন। 

পড়ালেখার প্রতি জসিমের আগ্রহ দেখে অবাক হন তার সহপাঠী লিপি আক্তার। জসিমকে আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন লিপি। জসিম জানান, একাদশ শ্রেণি থেকে লিপির সহায়তায় তিনি পড়ালেখা করছেন। তিন বছর আগে লিপির বিয়ে হয়। বর্তমানে তিনি স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে বসবাস করছেন। কিন্তু সেখানে থেকে নিয়মিত জসিমের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছেন। এখন লিপির স্বামীও জসিমের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। 

জসিম বলেন, ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি বাবাকে চা দোকানে সহযোগিতা করতেন। দুই বছর আগে একই এলাকায় রোকেয়া বেগমের সঙ্গে জসিম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরে এখন একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। এতে তার সংসারে খরচও বেড়েছে। এ জন্য অন্যের বোঝা না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ও পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরানোর জন্য জসিম ব্যবসা শুরু করেন। এখন তার প্রতিদিনের আয় দিয়ে বড় হচ্ছে ব্যবসা, আবার সংসার চালাতে অর্থ দিয়ে বাবাকে সহযোগিতা করছেন। 

জসিম উদ্দিনের ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল চাকরি করার। সেজন্য অনার্স শেষ করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আবেদনও করেছেন। এখন সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা থাকলে তার ইচ্ছা পূরণ হবে। অন্যথায় দোকান বড় করবেন। নিজের ও পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাবেন। তাছাড়াও তিনি ব্যবসা করে প্রমাণ করতে চান, দৃষ্টিহীনরা সমাজের বোঝা নয়।

ঢাকা/বকুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়