ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

জন্মের সময় মা, কিছু বুঝে ওঠার আগেই হত‌্যা হলো বাবা

ফরিদপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:২৯, ৪ মে ২০২২  
জন্মের সময় মা, কিছু বুঝে ওঠার আগেই হত‌্যা হলো বাবা

ফুফুর কোলে শিশু আছিয়া

দুই বছর বয়সী শিশুকন্যা আছিয়া। কথা বলা শিখেনি এখনো। কিছুই বুঝতে পারছে না। বাড়িতে বইছে শোকের মাতম। আছিয়া শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ফুফু রহিমা বেগম তাকে কোলে করে রেখেছে। আছিয়াকে জন্ম দিয়েই তার মা অমিতা বেগম চলে যান না ফেরার দেশে। মায়ের মৃত্যুর পর একদিন বয়স থেকেই আছিয়াকে লালন-পালন করছেন তার ফুফু রহিমা বেগম। এবার প্রতিপক্ষের লোকজন নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করলো আছিয়ার পিতা আকিদুল মোল্যাকে। 

জন্মের সময় মাকে, আর দুই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেলো আছিয়া। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হারাতে হলো সবচেয়ে প্রিয় দুই জন মানুষকে। আছিয়া বাবা-মা বলে ডাকতেও পারলো না, আর কোনদিন পারবে না। জন্মদাতা পিতা-মাতার মৃত্যুও বুঝতে পারলো না।

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঈদের দিন মঙ্গলবার (৩ মে) দুপুরে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের চরদৈত্বেরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা শিশু আছিয়ার পিতা আকিদুল মোল্যাকে (৪৬) গোহাইলবাড়ি বাজারের পাশে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। আকিদুল ইসলাম গোহাইলবাড়ি বাজারে পাট ও ভুসি মালের ব্যবসা করতেন।

শুধুমাত্র আছিয়াই নয়, পিতা-মাতা হারিয়ে এতিম হয়ে গেলো ওরা ৫ ভাই-বোন। আছিয়া সবার ছোট। আছিয়ার বড় ভাই আজিজুল (১৫) গোহাইলবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র, মেঝো ভাই রিয়াজুল (১২) পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, মুস্তাকিন (১০) চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ও মমিন (৮) ব্র্যাকের শিশু শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, শিশু আছিয়া তার ফুফু রহিমা বেগমের কোলে রয়েছে। বাড়িতে শোকের মাতম বইছে। নিহত আকিদুলের ৪ ছেলের কান্নাকাটিতে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। আকিদুলের বৃদ্ধা মা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। শুধু পরিবার নয়, আশপাশের মানুষও কান্নাকাটি করছে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। 

নিহত আকিদুল মোল্যার বড় ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র আজিজুল জানায়, তার পিতা ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি আসে। তারপর দুপুরে বাড়ি থেকে দোকানের উদ্দেশে রওনা হয়। গোহাইলবাড়ি বাজারের কাছে আসতেই আগে থেকেই ওৎ পেতে থাকা প্রতিপক্ষের লোকজন বাবার ওপর হামলা চালায়। বাবাকে কুপিয়ে জখম করে। বাবা ওই স্থানেই মারা যায়। 

আজিজুল বলেন, আমরা চার ভাই, ১ বোন। দুই বছর আগে ছোট বোনের জন্মের সময় মা মারা যায়। বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করলো ওরা। আমরা এতিম হয়ে গেলাম। আমাদের আর দেখাশুনার কেউ থাকলো না। আমি বাবা হত্যার বিচার চাই। 

নিহত আকিদুল মোল্যার ছোট ভাই দবির মোল্যা বলেন, আমার ভাইয়ের সাথে কারো কোনো ঝামেলা ছিল না। গ্রাম্য দলাদলি থাকলেও ভাই কখনো ঝামেলায় জড়াতো না। খুব নিরীহ মানুষ ছিল। ওরা আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করলো। মারপিটের সময় আমার ভাই ওদের বলেছিল; ‘আমার স্ত্রী বেঁচে নেই, আমাকে প্রাণে মারিস না। আমার ছেলে-মেয়ে এতিম হয়ে যাবে, ওদের দেখার কেউ থাকবে না’। কিন্তু একথা শোনেনি ওরা। ভাইকে এমনভাবে মেরেছে যে ওই স্থানেই মারা গেছে। হাসপাতালে নেওয়ারও সুযোগ হয়নি।

নিহত আকিদুল মোল্যার বোন রহিমা বেগম বলেন, বড় ভাইয়ের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তার মেয়ে আছিয়াকে আমিই দেখাশোনা করি। মেয়েটার কপাল এতোটাই খারাপ, জন্মের সময় মাকে হারালো; বুঝে উঠার আগেই বাবা নেই। ওরা পাঁচ ভাই-বোন এতিম হয়ে গেলো।

আকিদুল মোল্যার বৃদ্ধ মা শাহিদা খাতুন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কথা বলতে পারছেন না। একটু কথা বলছেন আর মূর্ছা যাচ্ছেন। বলেন, আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। আমার নাতি-নাতনিরা এতিম হয়ে গেলো। একজন মা বেঁচে থাকতে তার সন্তানের মৃত্যু কতটা কষ্টের, তা যে হারায় সে বোঝে। আমার ছেলের বদলে আমারে নিলে না কেনো আল্লাহ, বলে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকেন তিনি।

জানা গেছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোস্তফা জামান সিদ্দিকী ও গোহাইলবাড়ি এলাকার মৃত বজলুর রহমানের ছেলে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন বিবাদ চলে আসছে। 

সম্প্রতি গোহাইলবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নির্বাচনে আরিফের পক্ষকে পরাজিত করে মোস্তফা জামান সিদ্দিকী সভাপতি নির্বাচিত হয়। এ ঘটনায় আরিফুজ্জামানের পক্ষের লোকজন ক্ষিপ্ত ছিল। 

ঈদের দিন দুপুরে গোহাইলবাড়ি বাজার সংলগ্ন এলাকায় মোস্তফা জামান সিদ্দিকীর সমর্থকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় আরিফের পক্ষের লোকজন। হামলায় চরদৈত্বেরকাঠি গ্রামের মৃত হাসেম মোল্যার ছেলে আকিদুল মোল্যা (৪৬), একই গ্রামের মৃত মোসলেম শেখের ছেলে খায়রুল শেখ (৪৭), মোস্তফা জামান সিদ্দিকীর দুই ভাই আলমগীর সিদ্দিকী (৫২) ও মাসুদ আহমেদকে (৪০), রাজিবুল ইসলাম (৩০), কাদের মোল্যা (৪০) ও সোহেল শেখ (২০) গুরুতর আহত হয়।

আহতদের বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আকিদুলকে মৃত ঘোষণা করেন। অপর গুরুতর আহত খায়রুলকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে সাতৈর বাজারে পৌঁছালে পথিমধ্যে সেও মারা যায়। 

গুরুতর আহত মোস্তফা জামান সিদ্দিকীর দুই ভাই আলমগীর সিদ্দিকী ও মাসুদ আহমেদকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অপর আহত রাজিবুল ইসলাম (৩০), কাদের মোল্যা (৪০) ও সোহেল শেখকে (২০) বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। 

এ রিপোর্ট খেলা পর্যন্ত বুধবার (বিকেল ৫টা) পর্যন্ত আকিদুলের মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডি‌ক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। 

বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঈদের দিন দুপুরে প্রতিপক্ষের লোকজন আকিদুল ও খায়রুল নামে দুই ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করে। এলাকায় ডিবি পুলিশ ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। 

তিনি আরো বলেন, এলাকা এখন শান্ত রয়েছে। বুধবার সকালে ময়না তদন্তের জন্য লাশ ফরিদপুরে পাঠানো হয়েছে। মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

উজ্জ্বল সিকদার/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়