ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

করোনাভাইরাস : হুমকিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৬, ৩ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 করোনাভাইরাস : হুমকিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি

চীনের উহান প্রদেশ থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রাথমিক হিসাবে শুধু কয়েকটি রপ্তানি খাতে ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া আমদানি নির্ভর খাতের উল্লেখজনক ক্ষতির আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন।

‘করোনাভাইরাসের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়তে পারে? ’ সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনকে। প্রাথমিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে ট্যারিফ কমিশন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে তিনটি খাতের সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ওঠে এসেছে। এই তিন খাত হচ্ছে, ফিনিশড লেদার, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ ও মুদ্রণ শিল্প। এর পাশাপাশি দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পও ভবিষ‌্যতে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

বাংলাদেশে আমদানিকৃত প্রাথমিক কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল ও সম্পূর্ণ পণ্যের বেশির ভাগ চীন থেকে আনা হয়। করোনাভাইরাসের ফলে চীনের স্থানীয় উৎপাদন থেকে শুরু করে রপ্তানি বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এই স্থবিরতার প্রভাব বাংলাদেশের বাণিজ্যে ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে।

প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য প্রভাবে খাতভিত্তিক পর্যালোচনা শীর্ষে স্থান পেয়েছে তৈরি পোশাক খাত।

ওভেন : ওভেন খাতের পণ্য চীন থেকে আমদানি হয়। করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

নিট : নিট খাতের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। এছাড়া নিট ও ডাইং কেমিক্যাল এবং এক্সেসরিজের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ আমদানি হয় চীন থেকে। বর্তমানে চীন থেকে সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। এ খাতেরও ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে।

ফিনিশড লেদার ও লেদার গুডস শিল্প : বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার ও লেদার গুডস শিল্প মোট যে পরিমাণ রপ্তানি করে তার মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ রপ্তানি হয় চীনে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ খাতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

গার্মেন্ট এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স শিল্প : গার্মেন্ট এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং খাতে বার্ষিক চার বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল প্রয়োজন হয়। যার ৪০ শতাংশ আসে চীন থেকে। কাঁচামালের প্রাপ্তি সংকুচিত হলে বা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে প্রায় এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ শিল্প : চীন থেকে কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ খাতে প্রতি মাসে আমদানির পরিমাণ ২০০ কনটেইনারেরও বেশি। যার মূল্য প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। বর্তমানে চীন থেকে এসব পণ্য আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ আছে।

ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স শিল্প : বাংলাদেশে আমদানি করা মেশিনারি ও স্পেয়ার পার্টসের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ চীন থেকে আসে। এ খাতের আমদানি ও জাহাজীকরণ বর্তমানে বন্ধ আছে। এ খাতের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রম কমিশনে চলমান বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

জুট স্পিনার্স শিল্প : জুট স্পিনার্স পণ্য চীনে রপ্তানির পরিমাণ বছরে আনুমানিক ৮১ হাজার মেট্রিক টন। যার মূল্য প্রায় ৫৩২ কোটি টাকা। চীনে রপ্তানি ও জাহাজীকরণ বর্তমানে বন্ধ আছে। এ খাতের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রমও চলমান।

মুদ্রণ শিল্প : মুদ্রণ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল চীন থেকে আসে।  এ খাতে বার্ষিক প্রায় ১৮০ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করা হয়। বর্তমানে আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ আছে। ফলে এ খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা।

মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স : মেডিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট চীন থেকে বার্ষিক প্রায় ২৫ কনটেইনার আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। বর্তমানে আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ আছে। এ খাতের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রম চলমান।

চশমাশিল্প : চশমাশিল্পের কাঁচামাল মোট আমদানির (তৈরি পণ্য ও যন্ত্রাংশ) আনুমানিক ৯৫ শতাংশ চীন থেকে আসে। বর্তমানে চীন থেকে আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ আছে। এ খাতের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রমও কমিশনে চলমান।

কম্পিউটার ও কম্পিউটার এক্সেসরিজ শিল্প : কম্পিউটারখাত অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল। ইতোমধ্যে কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ, এক্সেসরিজ ইত্যাদির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।

ইলেকট্রনিক্স শিল্প : টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, ওভেন, চার্জারসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ৮০ ভাগই আসে চীন থেকে। শিপমেন্ট বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে ইতোমধ্যে পণ্যের সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করেছে।

লাইভ অ্যান্ড চিলড ফুড শিল্প : গত ২৫ জানুয়ারি থেকে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ কাঁকড়া ও কুঁচিয়া চীনে রপ্তানি হয়। স্থানীয় বাজারে এসব পণ্যের কোনো চাহিদা নেই। তাই পণ্যগুলো রপ্তানি করতে না পারায় গত এক মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকার জীবন্ত কাঁকড়া ও কুঁচিয়া মারা গেছে। মজুদ করা পণ্য রপ্তানি করতে না পারলে ক্ষতি ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

প্লাস্টিক শিল্প: কাঁচামাল ও মেশিনারিজসহ বিভিন্ন মেশিনের স্পেয়ার পার্টস যেমন— ইনজেকশন মোল্ডিং, প্রিন্টিংসহ বিভিন্ন মেশিনের পার্টস চীন থেকে আনতে হয়। এসব পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ সেক্টর হুমকির সম্মুখীন।

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন সম্পর্কে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনটি একেবারেই প্রাথমিক তথ্যের ওপর করা হয়েছে। কমিশন এ মাসের শেষে আরো একটি প্রতিবেদন জমা দেবে তখন দেশের অর্থনীতির ওপর করোনার প্রভাবের একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।

এর আগে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি; ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই)পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কাছে বিশেষ ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।

 

ঢাকা/হাসনাত/জেনিস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়