ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বছরজুড়ে বিএসইসি’র নানা উদ্যোগে ইতিবাচক শেয়ার বাজার

নুরুজ্জামান তানিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৫, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৬:২৭, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১
বছরজুড়ে বিএসইসি’র নানা উদ্যোগে ইতিবাচক শেয়ার বাজার

দীর্ঘ মন্দা ও করোনা পরিস্থিতি পাশ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের শেয়ার বাজার। এরই ধারাবাহিকতায় শেয়ার বাজারে সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধনে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। ফলে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। বছরজুড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নানামুখী কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে শেয়ার বাজার ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যে ২০২০ সালের ১৭ মে বিএসইসি তথা শেয়ার বাজারের হাল ধরেন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন সাবেক শিল্প সচিব আব্দুল হালিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন্স সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। যোগদানের এক বছরের মধ্যে নতুন এই কমিশনের উদ্যোগী কর্মকাণ্ড ও কর্ম তৎপরতায় শেয়ার বাজারে গতি ফিরে এসেছে। একইসঙ্গে হারানো আস্থা ফিরে পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

বিগত কয়েক বছর মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করলেও চলতি বছরের শুরু থেকে শেয়ার বাজার পরিস্থিতি ভালো ছিল। তবে তখনও ছিল বৈশ্বিক মহামারি করোনার আঘাত। দীর্ঘদিনের আস্থা সঙ্কটসহ করোনার আঘাত সামলে শেয়ার বাজারকে ইতিবাচক রাখা বিএসইসির নতুন কমিশনের জন্য ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণসহ শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতায় ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছেন নতুন কমিশন।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জিরো টলারেন্স নীতিতে গত এক বছরে শেয়ার বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও গত আগস্টে সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করে বিশ্বসেরা খেতাব পেয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ওই সময়ে পুঁজিবাজারে ১৫.৮০ শতাংশ উত্থান হয়েছে। পুনর্গঠিত বিএসইসি’র ওপর আস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, বিগত কমিশনের আমলে শেয়ার বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল তলানিতে। তবে বিএসইসি’র নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামসহ অন্যান্য কমিশনারদের দায়িত্ব গ্রহণের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অনিয়ম, কারসাজি বন্ধে তাদের নেওয়া দৃঢ় পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পেয়েছে বলে এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে করোনা পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত লকডাউনে শেয়ার বাজার খোলা রাখার ব্যবস্থা নেওয়া, সুশাসন ফেরাতে আইন সংস্কার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ, সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ ও এককভাবে ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ না থাকা কোম্পানিগুলোর ওপর কঠোরতা আরোপ, দুর্বল ও লোকসানি কোম্পানিতে স্বচ্ছতা আনতে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পরিবর্তনেরও নির্দেশনা জারি; শেয়ার বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্বল কোম্পানির পরিচালকদের শেয়ার ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠন, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আসা কোম্পানির শেয়ার আনুপাতিক সমবন্টন, স্বচ্ছতা নিশ্চিতে একাধিক আইপিও বাতিল, ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেট (ওটিসি) বাতিল করে এসএমই প্ল্যাটফর্ম চালু, অল্টারনেটিভ প্ল্যাটফর্ম গঠন ও ওটিসির কোম্পানিগুলোর অবসায়নের নির্দেশনা জারি, ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার এবং সার্কিট ব্রেকার আরোপ, ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ প্রদানের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, লভ্যাংশ না দেওয়া ও নামমাত্র লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া সকল তফসিলি ব্যাংকের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ, বুকবিল্ডিংয়ের বিডিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়ানোর উদ্যোগ, বিনিয়োগ বাড়াতে দেশে-বিদেশে ব্রোকার হাউজের শাখা হিসেবে ডিজিটাল বুথ স্থাপন, শেয়ার বাজারের ব্র্যান্ডিং ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন দেশে রোড শো আয়োজন, বিএসইসিসহ স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ, স্টক এক্সচেঞ্জে বন্ড, সুকুক ও ট্রেজারি বন্ড চালু, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ, ব্রোকারেজ হাউজের সংখ্যা বাড়াতে নতুন ট্রেক ইস্যুকরণ, করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়ালি এজিএম বা ইজিএম বা পর্ষদ সভা করার উদ্যোগ, বাজার মধ্যস্থতাকারীদের কাজে উৎসাহ বাড়াতে পুরস্কার প্রদানের উদ্যোগ, স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ, মার্কেট মেকারের অনুমোদন, পাঠ্যপুস্তকে বিনিয়োগ শিক্ষার অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ এবং উভয় স্টক এক্সচেঞ্জকে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ডিএসই’র ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫৬১৮.৯৫ পয়েন্টে। আর ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করছে ৬৮৬৮.১৭ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স সূচক বেড়েছে ১২৪৯.২২ পয়েন্ট। তবে চলতি বছরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডিএসইক্স সূচক ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে নতুন রেকর্ড গড়েছে। চলতি বছরের ১০ অক্টোবর ডিএসই’র ডিএসইএক্স সূচক ৭ হাজার ৩৪৭.৯৯ পয়েন্টে স্পর্শ করে সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে। তবে চলতি বছরের ৪ এপ্রিল সূচকটি ৫ হাজার ৮৮.৯৮ পয়েন্টে নেমে আসে।  এদিকে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ডিএসই’র ডিএসইএস সূচক ছিল ১৪৬২.৩০ পয়েন্ট। আর চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএস সূচক অবস্থান করছে ১২৯৯.৫২ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস সূচক বেড়েছে ১৬২.৭৮ পয়েন্ট।

এ ছাড়া চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ডিএসই’র ডিএস৩০ সূচক ছিল ২৫৮৬.৪৬ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএস৩০ সূচক অবস্থান করছে ২০৭৮.৯৫ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএস৩০ সূচক বেড়েছে ৫০৭.৫১ পয়েন্ট।

এ বিষয়ে শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘গত এক বছরের শেয়ার বাজারের উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নতুন কমিশন নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে গত এক বছরে শেয়ার বাজারে সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধন বেড়েছে। সে হিসেবে গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর শেয়ার বাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। সব মিলিয়ে শেয়ার বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীর আস্থা বেড়েছে।’

এদিকে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘শেয়ার বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। যদিও বিএসইসির জন্য এ বিষয়টি খুব চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। তবে যোগ্য নেতৃত্বের কারণে দীর্ঘদিনের আস্থার সঙ্কট দূর করে শেয়ার বাজারকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে এনেছে বিএসইসি। এতে শেয়ার বাজারের ওপর হারানো আস্থা ফিরে পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ ছাড়া কারসাজির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। পাশাপাশি ভালো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়াসহ বুকবিল্ডিং প্রক্রিয়া আরো আধুনিকায়ন প্রয়োজন।’

ঢাকা/এনএইচ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়