ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

টিসিবির পণ্য কিনতে ভিড়, খালি হাতে ফিরছেন হতাশ ক্রেতা

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৮, ৭ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১৪:৫০, ৭ মার্চ ২০২২
টিসিবির পণ্য কিনতে ভিড়, খালি হাতে ফিরছেন হতাশ ক্রেতা

ঢাকায় টিসিবি পণ্য কিনতে ভিড়। ছবি: রাইজিংবিডি

চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের বাজার চড়া। তাই ন্যায্যমূল্যে পণ্য পেতে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের দীর্ঘ সারি। এর মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষ যেমন আছেন, তেমনি মধ্যবিত্তের সংখ্যাও কম নয়।

সোমবার (৭ মার্চ) রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে, টিসিবি পণ্য কিনতে আসা মানুষের সঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডির প্রতিবেদকের। এ সময় এই চিত্র দেখা যায়।

এক সপ্তাহ বিরতির পর রাজধানীর ১৫০টি স্পটে আবারও ট্রাকে করে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি শুরু করেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এর মধ্যে নির্ধারিত কয়েকটি এলাকায় টিসিবি পরিবেশকের ট্রাক সময় মতো না আসায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে ফিরে গেছেন লোকজন। কোথাও অতিরিক্ত ভিড় হওয়ায় ঝগড়ার পাশাপাশি হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটেছে।

সবশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারিতে পণ্য বিক্রয়ের পর গতকাল রোববার (৬ মার্চ) আবার ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে পরিবেশকদের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম শুরু করেছে টিসিবি। এবারের বিক্রয় কার্যক্রম চলবে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ১৫০টি ট্রাকে চিনি, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজ, এ চারটি খাদ্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছে।  শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন বিক্রি করা হচ্ছে এসব পণ্য।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর বছিলা এলাকায় দেখা যায়, প্রায় ২৫০ নারী-পুরুষ টিসিবির পণ্য নেওয়ার জন্য এই গরমের মধ্যেও লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন। তাদের অনেকে বলেন, সর্বশেষ বিক্রির দিন বলেছিল, ৬ মার্চ থেকে আবার গাড়িতে মালামাল নিয়ে তারা আসবে।  কিন্তু গতকাল আসেনি তারা, আজও না।

সেগুনবাগিচা দুর্নীতি দমন কমিশন অফিসের সামনে আলাদা লাইন ধরে অপেক্ষা করেন প্রায় ৩০০ নারী-পুরুষ। এখানে সকাল সাড়ে ১১টায় টিসিবির ট্রাক এসেছে বলে জানান টিসিবি পরিবেশক মনজুর ট্রেডার্সের বিক্রয়কর্মী রহমান। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা খোদেজা বেগম একজন গৃহকর্মী।  গত মাসে টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছিলেন চারবার। কিন্তু বাসায় কাজ শেষ করে আসতে দেরি হওয়ায় চারবারের মধ্যে দুইবারই পণ্য পাননি।  তাই আজ ছুটি নিয়ে এসেছেন সকাল সাড়ে আটটায়। সেই থেকে লাইনে আছেন।

পণ্য কিনতে আসা পুরুষদের সারিতে ২০ নম্বরে আছেন মোর্শেদ আলী। ঘণ্টা দুয়েক ধরে অপেক্ষা করছেন। গরম, ঘামে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মোর্শেদ আলী বলেন, ‘কাজ করে সব মিলিয়ে ১২-১৩ হাজার টাকা পাই।  সেই টাকা বাসা ভাড়া আর খাওয়া খরচেই চলে যায়। দুইটা ছেলে পড়াশোনা করে। বড়টা আগামীবার এসএসসি দেবে। ছোটটা ক্লাস সিক্সে পড়ে। সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে।’

অন্যের বাসার কাজ ফেলে টিসিবি পণ্য নিতে আসা মরিয়ম বেগমের কণ্ঠে ছিল হতাশা। তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ দিনে ডাল আর আলু ভর্তা দিয়া ভাত খাই। পোলামাইয়া দুইডা খাইতে বইলে কান্দে। ওগোরে এট্টু ভালোমন্দ খাওয়াইতে পারি না। গত মাসে তেল পাই নাই, তাই তরকারি রান্না করতে পারি নাই।  বাচ্চারা ভাজি, ডাল, তরকারি, মাছ খাইতে চায়। কেমনে খাওয়ামু কন?’

করিম মুন্সি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বেতন পান ২৫ হাজার টাকা। তিনি প্রতি মাসে দুইবার করে টিসিবির ট্রাক থেকে চিনি, ডাল, তেল ও পেঁয়াজ এই চারটি পণ্যেরই প্রতিটি দুই কেজি করে কেনেন।  তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে লজ্জা লাগতো, লাইনে দাঁড়িয়ে এসব কিনতে।  এখন আর লাগে না। লজ্জা পেলে কি আর জীবন চলবে? এসব পণ্য দিয়ে সারা মাস চালাই। দুই কেজি করে পণ্যের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তেল না পেলে মনটা খারাপ হয়।’

সেগুনবাগিচার এক হোটেল ব্যবসায়ী জানান, ‘প্রতিদিন লোকজন টিসিবির মালামাল কিনতে আসে।  ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরে অপেক্ষা করে।  বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে, মানুষের বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে পড়ছে। চাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনি, ডাল এসব পণ্যের দাম তো প্রায় প্রতিদিন বাড়ছে। তাই দিন দিন টিসিবির ট্রাকের লাইনে মানুষ বাড়ছে।’

প্রতিটি কেন্দ্রেই ট্রাক আসে ১১টার পরে।  অথচ মানুষ এসে জমায়েত হয় সকাল ৮-৯টা থেকে। সেগুনবাগিচায় পণ্য দেওয়া শুরু হয়েছে সকাল পৌনে ১২টার দিকে।  এখানে কথা হয় লাইনে থাকা জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রোদের মধ্যে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আসার পর ১১ জনের পেছনে ছিলাম, এখন আছি ৬ জনের পেছনে। এর মধ্যে অনেকে তাদের খাতিরের লোক লাইনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। পেঁয়াজ আর তেল কেনার জন্যই এসেছি। এর বাইরেও ডাল ও চিনি নিতে হবে। বাজারের দামের চেয়ে অনেক কম দাম বলে কষ্ট করে হলেও এখান থেকে কিনি।’

টিসিবির পরিবেশক মনজুর ট্রেডার্সের পণ্য বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘মানুষজন সিরিয়ালে থেকেও ঝগড়া আর ধাক্কাধাক্কি করে।  লাইন ঠিক না করলে পণ্য দেবো কীভাবে? আর লাইন ঠিক করা আমাদের কাজ না। যিনি লাইনে ট্রাকের কাছে আসেন, তাকেই আমরা পণ্য দেই। তবে সবাইকে দিতে পারি না। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ মানুষকে দেই।  লাইন ধরে ৩৫০ থেকে ৪০০ মানুষ। আমরা পণ্য দিয়ে, টাকার হিসাব করতে করতেই হয়রান হয়ে যাই। ভুল করলে নিজের পকেট থেকে দিতে হবে।’

ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সব স্পটেই মানুষের ভিড় হয়। এক পরিবার থেকে একাধিক মানুষও এসে লাইনে দাঁড়ায়। অন্যরা অভিযোগ করে। আমরা কী করবো বলুন? যতক্ষণ ট্রাকে মালামাল থাকে, আমরা মানুষকে দিতে বাধ্য। অন্যকিছু দেখার এত সময় কোথায়?’

উল্লেখ্য, বর্তমানে টিসিবির ট্রাকে প্রতি কেজি চিনির দাম ৫৫ টাকা, মসুর ডাল ৬৫ টাকা, সয়াবিন তেল দুই লিটার ২২০ টাকা ও পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একজন দুই কেজি করে ডাল, চিনি, পেঁয়াজ ও দুই লিটার তেল কিনতে পারেন।

/মেয়া/এসবি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়