ইউনাইটেড এয়ারের আগের পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্ত, বিশেষ নিরীক্ষা
পুঁজিবাজারের ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি) স্থানান্তরে অপেক্ষমাণ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আগের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একইসঙ্গে কোম্পানিটির আর্থিক অসঙ্গতি খতিয়ে দেখতে ২০১২-২১ সাল পর্যন্ত সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
কোম্পানিটির পূর্বের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে তাহবিল তসরুপের অভিযোগ রয়েছে। তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আগের পরিচালনা পর্ষদ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে কারসাজি করে ইচ্ছাকৃতভাবে লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ১০ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিএসইসির কমিশন সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) তদন্তের বিষয়ে বিএসইসি একটি আদেশ জারি করা হয়েছে। তবে বিশেষ নিরীক্ষার বিষয়ে বিএসইসির কোনও আদেশ জারি করা হয়নি বলে জানা গেছে।
বিএসইসির কমিশন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পূর্বের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম বিএসইসির এসআরএমআইসি বিভাগ এবং নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষার কার্যক্রম সিএফডি বিভাগ দেখভাল করবে।
তদন্তর বিষয়ে জারি করা আদেশে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সার্বিক বিষয়ের ওপর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন বলে মনে করে কমিশন। এরই ধারাবাহিকতায় সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ (১৯৬৯ সালের অর্ডিন্যান্স নং xvii) এর ২১ ধারা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ (১৯৯৩ সালের ১৫নং আইন) এর ১৭ক ধারা অনুযায়ী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হলো। গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মো. ওহিদুল ইসলাম, উপ-পরিচালক শাহরিয়ার পারভেজ, উপ-পরিচালক মো. শাহনেওয়াজ, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একজন সদস্য এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার একজন সদস্য। তদন্ত কর্মকর্তাদের এ আদেশ জারির ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে বিএসইসতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
সূত্রে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বেবিচকের পাওনা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা দেনা মওকুফের আবেদন জানিয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। একইসঙ্গে কোম্পানিটির এ আবেদনের বিষয়ে সুপারিশ করেছে বিএসইসি। এ অবস্থায় কোম্পানিটি বন্ধ হওয়ার কারণ, বন্ধ হওয়ার পেছনে কারা জড়িত ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে মন্ত্রণালয়।
তথ্য মতে, দীর্ঘদিন হতে বন্ধ থাকা ও পরিত্যক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে ১ লাখ ৬০ হাজার প্রান্তিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত প্রায় ৭৯৩ কোটি টাকার সুরক্ষার্থে বিএসইসি ৮ জন অভিজ্ঞ স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। তবে কোম্পানিটির সাবেক ফাউন্ডার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসারুল আহমেদ চৌধুরী বিদেশে পলাতক রয়েছেন। নতুন পরিচালনা পর্ষদ ২০২১ সালের ৪ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই এয়ারলাইনটি পুনর্জীবিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এদিকে, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়া ও বিভিন্ন সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের কারণে ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মূল মার্কেট থেকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। একইসঙ্গে গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে কোম্পানিটির সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করা কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। এ ব্যর্থতার জন্য কোম্পানিটির সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালকসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা দায়ী বলে মনে কমিশন। পরবর্তীতে ২০২১ সালের বছরের ১২ জানুয়ারি ইউনাইটেড এয়ারকে ওটিসি মার্কেটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।
অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বিএসইসি। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে মনোনীত স্বতন্ত্র পরিচালকরা হলেন- কাজী ওয়াহিদ উল আলম, এম সাদিকুল ইসলাম, মাসকুদুর রহমান সরকার, এটিএম নজরুল ইসলাম, প্রফেসর ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, মুহাম্মদ ইউনুস, মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ ও সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। কোম্পানিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন কাজী ওয়াহিদ উল আলম। আর এ ডুবন্ত ইউনাইটেড এয়ারকে সচল করার উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন বিনিয়োগকারীরা।
২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিএসইসি ওটিসি মার্কেট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ওটিসি মার্কেটের কোম্পানিগুলোকে আর্থিক সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ভিত্তিতে এসএমই প্ল্যাটফর্ম ও এটিবিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এরই ধারাবাহিকতায় বিএসইসি’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউনাইটেড এয়ারকে ওটিসি থেকে এটিবিতে স্থানান্তর করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদ উল আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, কোম্পানিটির পূর্বের পরিচালনা পর্ষদের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে বিএসইসি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোম্পানিটির আগের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে তহবিল তসরুপের অভিযোগ রয়েছে। গঠিত কমিটি তা খতিয়ে দেখবে। এক্ষেত্রে কোম্পানিটির পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের কাজে কোনও অসুবিধা হবে না। কোম্পানিটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। এ কাজে বিএসইসি সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে।
এদিকে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সাবেক ফাউন্ডার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে ১ কোটি শেয়ার ছেড়ে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তালিকাভুক্তির পরের বছর ২০১১ সালে কোম্পানিটি ১০ টাকা ফেসভ্যালুর সঙ্গে অতিরিক্ত ৫ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে ২১ কোটি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৩১৫ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করে। ৮২৮ কোটি ১০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৮২ কোটি ৮০ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮০টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ২.৫ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১১.০৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৮৬.৪৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার সর্বশেষ ১.৯০ টাকায় লেনদেন হয়েছে।
ঢাকা/এনটি/এনএইচ
আরো পড়ুন