ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কু-ঋণের লাগাম টানতে আইন প্রণয়নে গতি বাড়ছে

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৫ নভেম্বর ২০২২   আপডেট: ০৮:৫৫, ১৫ নভেম্বর ২০২২
কু-ঋণের লাগাম টানতে আইন প্রণয়নে গতি বাড়ছে

কু-ঋণ বা খারাপ ঋণ কিনে নেওয়ার জন্য সরকারি পর্যায়ে একটি কোম্পানি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ) উদ্যোগে কোম্পানি গঠন প্রক্রিয়ায় আবার গতি আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, পক্ষকাল ঢাকায় অবস্থানকালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ঋণ নিয়ে আলোচনার সময় এ বিষয়টিও সামনে এসছে। এই কোম্পানি দ্রুত গঠনের জন্য আইএমএফ শর্তও দিয়েছে বলে জানা গেছে। গত বুধবার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আমরা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের কাজ শুরু করেছিলাম। এর বেশি তিনি আর বিস্তারিত কিছু জানাননি।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি পরিমাণ কোনোভাবে কমানো সম্ভব হচ্ছে না। গেলো সেপ্টেম্বরে দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এ বিবেচনায় এখন খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। আইএমএফ পক্ষ থেকে শর্ত দেওয়া হয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অবশ্যই ১০ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। এটি এখন ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশের ঘরে রয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন (বামকো)’ শীর্ষক প্রতিষ্ঠানটি গঠন করে ব্যাংকের মন্দ বা কু-ঋণ কিনে নেওয়া হবে। পরবর্তীতে এই ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় করা হবে। কিন্তু আড়াই বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোম্পানি গঠনে আলোর মুখ দেখেনি। দুই বছর আগে কোম্পানি গঠনের জন্য একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। খসড়াটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল বলে জানা গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২০ সালের শুরুর দিকে এ কোম্পানি গঠনের প্রাথমিক কাজ শুরু করা হয়। আমলানির্ভর এ কোম্পানিকে ঋণ খেলাপিদের প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ ও বিক্রি করারও ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে থাকার কথা ছিল পদাধিকার বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। করপোরেশনের সদস্য সংখ্যা হবে ১০ এবং পরিশোধিত মূলধন তিন হাজার কোটি টাকা এবং অনুমোদিত মূলধন থাকবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত এ আইনের নামকরণ করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন আইন-২০২০’ (বিএএমসিও)।

এই কোম্পানি খেলাপি ঋণের পুনঃতফসিল এবং পুনর্গঠন করে দেওয়া এবং যেকোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণও কিনে নেয়ওার ক্ষমতা থাকবে এই করপোরেশনের। করপোরেশন আয় ও মুনাফা হবে সম্পূর্ণ কর মুক্ত। কাজ করতে পারবে কোনো খেলাপি প্রতিষ্ঠানের ‘রিসিভার’ হিসেবেও। করপোরেশনের সিইওকে নিয়োগ দেবে সরকার। পরিচালনা পর্ষদকে ‘সততা ও বিশ্বস্ততার’ শপথ নিতে হবে। আর এ কোম্পানি গঠন করা হবে একটি নতুন আইনের অধীনে।

কোম্পানি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের শুরুতে এ আইনের একটি খসড়া তৈরি করে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা ছিল। খসড়াটি তৈরিও করা হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে এই নিয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

জানা গেছে, এই করপোরেশনকে একটি ‘বিধিবদ্ধ’ সংস্থা হিসেবে বর্ণনা করে আইনে বলা হয়েছে, ‘এই করপোরেশনের একটি সীলমোহরও থাকবে। এবং করপোরেশন মামলাও করতে পারবে।

করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিষয়ে এই আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, করপোরেশনে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হবেন পদাধিকার বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব। তার অধীনে পর্ষদে সদস্য হিসেবে থাকবেন অর্থ বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন সদস্য, রেজিষ্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন সদস্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের একজন সদস্য, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র মনোনীত একজন সদস্য, করপোরেশন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পর্ষদের মেয়াদ হবে তিন বছর।

সূত্র জানায়, ২৯ পৃষ্ঠার এই আইনের ধারা রয়েছে মোট ৪৬টি। এ ধারার মধ্যে আবার রয়েছে অনেক উপ-ধারা। এমনই এক ধারা হচ্ছে-২৪। এই ধারায় বামকোকে ‘নন-পারফর্মিং ঋণ’ (খেলাপি ঋণ) আদায় ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন কার্যকর হবার সঙ্গে সঙ্গে, অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ননপারফর্মিং ঋণ আদায় ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।

এ কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ব্যবসায়ের যথাযথ দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বা কর্তৃত্ব গ্রহণ (টেকওভার); ঋণগ্রহীতার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ব্যবসায়ের সম্পূর্ণ বা আংশিক বিক্রি বা লিজ দিতে পারবে। ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক প্রদেয় ননপারফর্মিং ঋণের পুনঃতফসিলীকরণ কিংবা পুনর্গঠন করতে পারবে। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক প্রদেয় বকেয়া নিষ্পত্তি করবে। এ ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে জামানতের দখল, সুরক্ষা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে লিজ বা বিক্রি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী কর্তৃক গৃহীত ঋণের, গুণগত মান বিবেচনা করে, সম্পূর্ণ বা যেকোনো অংশ শেয়ারে রূপান্তরকরণ করতে পারবে করপোরেশন।

এ আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন’ অর্থ এ আইনের অধীন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ননপারফর্মিং ‘জামানতী ঋণ বা অগ্রিম’ ক্রয়-বিক্রি, সংরক্ষণ, আদায়, পুনর্গঠন, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সম্পদের সিকিউরিটাইজেশন ও ব্যবস্থাপনা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্সিং, আধুনিকায়ন, বিস্তার ও প্রতিস্থাপন (বিএমআরই), পরামর্শ প্রদান এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা মূলধন বা উদ্ভাবন মূলধন প্রদান ও ব্যবস্থাপনাকারী কোনো বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে বিবেচিত হবে।

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘করপোরেশন একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হবে এবং এর স্থায়ী ধারাবাহিকতা ও একটি সাধারণ সীলমোহর থাকবে এবং এই আইনের বিধান সাপেক্ষে, এর স্থাবর ও অস্থাবর, উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করবার, অধিকারে রাখবার এবং হস্তান্তর করবার ক্ষমতা থাকবে এবং করপোরেশনের নিজ নামে মামলা দায়ের করতে পারবে।’ খেলাপি ঋণ আদায়ে বা হ্রাস করার জন্য এই করপোরেশন যেকোনো দেশি বা বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করতে পারবে। এই করপোরেশনের তালিকাভুক্তি ছাড়া কোনো অ্যাজেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কাজ করতে পারবে না। এই সদর দফতর ঢাকায় হবে, কিন্তু শাখা অন্যান্য জায়গাও হতে পারে।

অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশনের কার্যাবলি সম্পর্কে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে-ঋণগ্রহীতা রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্সিং, আধুনিকায়ন, বিএমআরই। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, দেউলিয়াবিষয়ক আইন, ১৯৯৭ (১৯৯৭ সনের ১০ নম্বর  আইন) এর ধারা ৭৪ অনুযায়ী ‘সরকারি রিসিভার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া করপোরেশন ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন, পোর্টফোলিও এবং সম্পদের পুনর্গঠন করতে পারবে। ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির সম্পদ বা জামানত অর্জন, নিষ্পত্তিকরণ এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির দেউলিয়াগ্রস্ত  অবস্থা চিহ্নিতকরণ ও সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আইনের ধারা-৭ এ করপোরেশনের শেয়ার মূলধনের বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, ‘করপোরেশনের অনুমোদিত শেয়ার মূলধন হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা যার প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের ৫০০ কোটি সাধারণ শেয়ারে বিভক্ত হবে; তবে শর্ত থাকে যে, সরকার, সময় সময়, অনুমোদিত শেয়ার মূলধন বাড়াতে পারবে।

করপোরেশনের পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকা, যা সরকারের অনুমোদনক্রমে, সময় সময়, বাড়ানো যাবে।’
 

/হাসনাত/সাইফ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়