ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘জ্ঞান অর্জন ও শেখার প্রতি আমাদের আগ্রহ কম’

সাইফুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৮, ২৬ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘জ্ঞান অর্জন ও শেখার প্রতি আমাদের আগ্রহ কম’

দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অসংখ্য শিক্ষার্থীর। বিভিন্ন বর্ষে বারবার অকৃতকার্য হয়ে শেষ করতে পারছেন না স্নাতক (সম্মান)।  এছাড়া প্রতিবছর ড্রপ-আউট হয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, ফলিত গণিত, ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগ, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমানে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ) বিভাগে শিক্ষার্থীরা উদ্বেগজনক হারে ফেল করছেন। এই ৬টি বিভাগে প্রথম বর্ষে যতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হন, তার অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক শেষ করতে পারছেন না। বিজ্ঞানের অন্য বিভাগগুলোর ফল পর্যালোচনা করে করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। শুধু তাই নই, ফেল করার কারণে প্রতিবছর ড্রপ আউট হয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী।

বিগত কয়েক বছরের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ভর্তি হন ৭২০ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে পাস করেন ৩১১ জন শিক্ষার্থী। এখানে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের সংখ্যার অর্ধেকেরও কম। গণিত বিভাগে ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ভর্তি হন ৬৮০ জন শিক্ষার্থী ও নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক পাস করেন ৩৪৩ জন। এখানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক। রসায়ন বিভাগে ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ভর্তি হন ৪৪০ জন এবং নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক পাস করেন ২৩৭ জন। ফলিত গণিত বিভাগের ২০১২-১৩ থেকে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ভর্তি হন ২৪০ জন ও স্নাতক পাস করেন ১২৪ জন শিক্ষার্থী।  এভাবে উল্লেখিত সবগুলো বিভাগের ফলাফল একই রকম। এছাড়া বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি বিভাগেও একই চিত্র।

এতো সংখ্যক ফেল ও ঝড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিভিন্ন বিভাগের মাস্টার্সের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, বিজ্ঞানের এই কঠিন বিষয়গুলোতে ভর্তির পর প্রথম বর্ষেই শিক্ষার্থীরা বুঝে উঠতে পারেন না তাদের কীভাবে কী করতে হবে। বিভাগগুলোতে সিলেবাসও অনেক বড় ও যুগোপযোগী নয়। এমন অনেক কোর্সও পড়ানো হয়, যেগুলোর কার্যকারিতা নেই বলে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক আগেই পড়ানো বন্ধ করা হয়েছে। বিভাগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্তঃসম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। অনেক সময়ই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে থেকে সঠিক দিক-নির্দেশনা পায় না। এসব সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের খুব একটা কাছে যেতে পারে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের অনেক কঠোরভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নকেও দুষছেন অনেক শিক্ষার্থী।

অন্যদিকে শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের বিষয়গুলো না বুঝে তারা বাজারের প্রচলিত নোট মুখস্থ করে পাস করতে চাইছে। যা কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে সম্ভব হলেও বিজ্ঞানে সম্ভব নয়। যারা নিয়মিত পড়াশোনা করছে, তারাই ভালো ফল করছে। তাছাড়া বিভাগুলোতে এমন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছেন, যাদের বিজ্ঞানের আগ্রহ নেই। এসএসসি ও এইচএসসিতে নেই শক্তিশালী ভিত্তি। ফলে ক্রমেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আবার অনেক শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব নেই। এছাড়া বিভাগুলোতে এমন অনেক শিক্ষকও নিয়োগ হচ্ছে, যাদের বিজ্ঞানের ভিত্তি ভালো নয়।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক বলেন, ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সংক্ষিপ্ত সাজেশনে প্রশ্ন মুখস্থ করে ভালো ফল করে। আবার সংক্ষিপ্ত পড়াশোনায় বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু তাদের ভিত্তিটা শক্তিশালী হচ্ছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সিলেবাসের সঙ্গে কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছে না। এখন এমন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে, যাদের বিজ্ঞানে আগ্রহ নেই, নেই এসএসসি ও এইচএসসিতে শক্তিশালী ভিত্তি। এদের মধ্যে থেকেই শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। ফলে ক্রমেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।’

ফল নিয়ে শিক্ষার্থীদের এমন করুণ অবস্থা সম্পর্কে বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক এম খলিলুর রহমান খান বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনা করে না ও ক্লাসে আসে না। হয়তো শিক্ষকরা ঠিকমতো পাঠদান করছেন না, এমনটাও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর অনেকে ক্লাস-পরীক্ষা কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করে না।’

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ফেল করার পেছনে ৩টি কারণ রয়েছে। প্রথমত শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যে পদ্ধতিতে পড়ালেখা করেছে, তা  মুখস্থ নির্ভর। তারা এই মানসিকতা নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় তারা তাল মেলাতে পারে না। দ্বিতীয়ত, আমরা শিক্ষকরা ছাত্রদের মোটিভেট করতে পারছি না। তৃতীয়ত, ক্লাসে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বোঝাতে পারছে না। তাছাড়া এখন অল্প পরিশ্রমে ভালো ফল করার প্রতি সবার আগ্রহ। কিন্তু জ্ঞান ও শেখার প্রতি আমাদের আগ্রহ কম।’


রাবি/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়