ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চঞ্চল চৌধুরী ‘তকদীর’-এ বোনাস : সৈয়দ আহমেদ শাওকী

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৮, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:২১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০
চঞ্চল চৌধুরী ‘তকদীর’-এ বোনাস : সৈয়দ আহমেদ শাওকী

তরুণ নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকী। ওয়েব সিরিজ ‘তকদীর’ নির্মাণ করে প্রশংসায় ভাসছেন। সম্প্রতি ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই-এ মুক্তি পেয়েছে এটি। বলা যায়, এরপরই ওয়েব সিরিজ নিয়ে নতুন করে ভাবছেন এ দেশের দর্শক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সিরিজের ইতিবাচক রিভিউ ছড়িয়ে পড়েছে। এই ওয়েব সিরিজ নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন নির্মাতা সৈয়দ আহমেদ শাওকী। কথোপকথনে ছিলেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম শান্ত।

রাইজিংবিডি: ‘তকদীর’ দর্শকদের প্রশংসা কুড়াচ্ছে। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগছে?

শাওকী: সব মিলিয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছি- যা একদমই প্রত্যাশা করিনি। কারণ দর্শকপ্রিয় হবেই এই মনোভাব নিয়ে চলচ্চিত্রটি আমি নির্মাণ করিনি। তবে আমি যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম সেভাবেই কাজটি করতে পেরেছি। ফলে টিমের সবার মধ্যেই কাজ নিয়ে আত্মতৃপ্তি রয়েছে। এদিক থেকে আমি অনেকটাই হ্যাপি!

রাইজিংবিডি: তার মানে বলতে চাচ্ছেন, আরো ভালো করা যেত— একজন নির্মাতা বা শিল্পীর এই ক্ষুধা থেকেই যায়। ‘তকদীর’ নির্মাণ করার পর আপনার কোনো অতৃপ্তি নেই?

শাওকী: অবশ্যই অতৃপ্তি রয়েছে! ৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের গল্প বলা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমার সর্বোচ্চ ৬০ মিনিট দৈর্ঘ্যের গল্প বলার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু ১৯০ মিনিটের গল্প বলার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। ‘তকদীর’ নির্মাণ করতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। গল্পের দৈর্ঘ্য যখন বেড়ে যায়, তখন গঠনগত সবকিছুর পরিবর্তন ঘটে, সঙ্গে প্রয়োজন হয় ধৈর্য্যের। বড় গল্পে অনেক কিছু বলা যায়, কিন্তু দীর্ঘ সময় দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখাই হলো চ্যালেঞ্জ।

শুধু তাই নয়, এই গল্পে শর্টনেস ছিল স্ক্রিপ্ট লেভেল থেকে। শুটিংয়ের সময় এর বিকল্প কোনো সমাধান ছিল না। এটাই আমার বড় দুর্বলতা। সম্পাদনার সময় মনে হয়েছে এটা করা যেত! আসলে সব কাজেই ফল্ট থাকে। তবে দর্শক যে অনুভূতির মধ্যে দিয়ে পুরো সিরিজটি দেখবে তা হয়তো আমি দিতে পেরেছি।

রাইজিংবিডি: দেশে ওয়েব সিরিজ নির্মাণের বয়স বেশি দিনের নয়। ‘তকদীর’ নির্মাণ করতে গিয়ে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?

শাওকী: এক কথায়- সময়। সাধারণত দেশে ৩ মাসের মধ্যে একটি স্ক্রিপ্ট ডেলিভারির জন্য বলা হয়। অর্থাৎ কোনো প্রি-প্ল্যান থাকে না। তারপর প্রি-প্রোডাকশন, পোস্ট প্রোডাকশনের টাইমে লিমিটেশন থাকে। এ কারণে চিত্রনাট্য রচনার কাজটি কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে আমি ভাগ্যবান। কারণ মার্চ মাসে চিত্রনাট্য রচনার কাজ শুরু করি। দীর্ঘ ৬ মাস সময় নিয়ে চিত্রনাট্যের কাজ শেষ করি। এই সময় পাওয়ার কারণে বিস্তারিতভাবে চিত্রনাট্যের কাজটি আত্মতৃপ্তির একটা লেভেলে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। তাছাড়া বাজেটের একটা ব্যাপার থাকে। যে বাজেট থাকে তা দিয়ে এক বছর নির্মাণ কাজ করে যাওয়া সম্ভব নয়। ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশের কনটেন্ট বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এখন দেখতে পাই। স্বাভাবিকভাবেই একটা রুচি তৈরি হয়েছে। সুতরাং ওইসব কনটেন্টের ধারেকাছে যেতে হলেও ওদের মতো সময়, রিসোর্স আমাদের প্রয়োজন।

রাইজিংবিডি: ‘তকদীর’ নির্মাণ করতে গিয়ে কী মনে হয়েছে- বাজেট আরো প্রয়োজন ছিল?

শাওকী: একটি মিনিমাম বাজেট, আরেকটি মেক্সিমাম। একটা টিমকে মার্কেট রেট অনুযায়ী ওয়েল পেমেন্টে দেওয়া হলে প্রত্যেকে কাজটির প্রতি শতভাগ ফোকাস করবেন। একজন শিল্পীকে তো টানা ৬ মাস একটি কাজে ব্যস্ত রাখা যায় না। কারণ তিনি মাল্টিপল কাজ করেন। আর তাকে তো অর্থনৈতিকভাবে সেই সাপোর্টটা দেওয়া সম্ভব নয়। আমি যখন কাজটি করেছি তখন মনে হয়েছে একটি লিমিটেড বাজেটে কাজটি করেছি।

রাইজিংবিডি: দেশে ওয়েব সিরিজ নিয়ে যখন বিতর্ক শুরু হলো, তখন আপনি ‘তকদীর’ নির্মাণে হাত দিলেন। এ পরিস্থিতিতে মনে হয়নি এটা আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ?

শাওকী: যে বিতর্ক হয়েছিল তার সঙ্গে ‘তকদীর’-এর কোনো কানেকশন নেই। ‘তকদীর’ নির্মাণ করতে গিয়ে কখনো মনে হয়নি আমার এই কাজকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হতে পারে। আগে যেসব কারণে ওয়েব সিরিজগুলো নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, তেমন কোনো বিষয় ‘তকদীর’-এ রাখা যাবে না, এজন্য আমার চিত্রনাট্যে কোনো পরিবর্তনও করিনি। তুলনা করে কাজ করতে গেলে গল্পের অনেস্টি চলে যাবে। যাদের ওয়েব সিরিজ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, আমি মনে করি তাদের কাছে যেটা সেরা মনে হয়েছে তারা সেটাই করেছেন। একটি গল্প নিয়ে কথা হবে, আলোচনা হবে সেটাই তো স্বাভাবিক! সেটা ‘তকদীর’ নিয়েও হওয়া উচিত।

রাইজিংবিডি: ‘তকদীর’-এর সফলতার মূল কারণ কী বলে মনে করেন?

শাওকী: এটা ‘তকদীর’-এর যতটা না ক্রেডিট, তারচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে করোনা। কারণ এই করোনাকালে অতিথি প্ল্যাটফর্মে গিয়ে কনটেন্ট দেখার আগ্রহটা বেড়ে গিয়েছে। মানুষ নিজেরাই বিভিন্ন জায়গায় গল্প খুঁজছে। আর এটা খুঁজতে গিয়েই মানুষের চোখে পড়েছে ‘তকদীর’। কত মানুষ দেখেছে আর কত মানুষের ভালো লেগেছে দুটি বিষয় ভিন্ন। বেশি মানুষ দেখলেই জনপ্রিয় হয়ে যাবে বিষয়টি তা নয়। বরং কত মানুষের ভালো লেগেছে সেটা বড় কথা! জনপ্রিয় কনটেন্ট মানেই ভালো কনটেন্ট—এটা পৃথিবীর কোথাও নেই। মানুষ ‘তকদীর’ দেখে ভালো বলছেন- এই আমার সফলতা।

রাইজিংবিডি: আপনি কী মনে করেন ‘তকদীর’ দেশের ওয়েব সিরিজে নতুন পথ দেখিয়েছে?

শাওকী: ‘তকদীর’ যদি সফল হয় তবে এর পুনরাবৃত্তি ঠিক হবে না। দর্শক শুধু সোশ্যাল ড্রামা, রহস্য দেখতে চায় সেটাও কিন্তু ঠিক না। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হলো বুফে রেস্টুরেন্টের মতো। এখানে সবরকম খাবার থাকবে। দর্শক কী খেতে চায় তা তারা নিজেরাই পছন্দ করবে। কারণ একেকজনের পছন্দ একেকরকম। সুতরাং দর্শকের জন্য সবরকম খাবার রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, দর্শক যাতে তার পছন্দমতো সময়ে এ খাবার গ্রহণ করতে পারে সেই সুবিধাও থাকতে হবে। আমি মনে করি, প্রত্যেক ফিল্ম মেকার যা ধারণ করে এবং বিশ্বাস করে তার সেটাই করা উচিত।

রাইজিংবিডি: ‘তকদীর’ পাইরেসি কবলে পড়েছে।

শাওকী: আসলে এই দায়িত্বটা হইচই প্ল্যাটফর্মের। এটা তো আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। এ বিষয়ে আমি এক্সপার্ট নই। কিন্তু যে কাজটি হয়েছে তা ‘অবৈধ’। সুতরাং কাজটি যারা করেছেন তারা খারাপ করেছেন। আর এক্ষেত্রে দর্শকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। যে কনটেন্টটি পাইরেসি হলো তার সঙ্গে ব্যবসা জড়িত। প্রযোজক যদি লোকসানে পড়েন তবে তিনি আর লগ্নি করবেন না। স্বাভাবিকভাবেই কনটেন্ট তৈরি বন্ধ হয়ে যাবে। যদি আরো ভালো কনটেন্ট তৈরি হয় তাহলে এখন যারা পাইরেসি করছেন, তারাও হয়তো এই প্ল্যাটফর্মের ক্রেতা হয়ে যাবেন। আস্তে আস্তে মানুষ ওটিট প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ত হচ্ছেন। কারণ এটি সহজ একটি মাধ্যম। মানুষ সহজ কিছু চায়।

রাইজিংবিডি: শুরুতেই বিদেশি প্ল্যাটফর্মে কাজ করলেন কেন?

শাওকী: সত্যি কথা বলতে আমার এই গল্প দেশি কোনো প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করা কঠিন হতো! আমি যে দেশের প্ল্যাটফর্মের জন্য বানাতে চেয়ে রিজেক্ট হয়েছি তা কিন্তু নয়। হয়তো কেউ না কেউ বানাতেন। কিন্তু যেভাবে গল্পটি বলতে চেয়েছি, সে অনুযায়ী সেল করাটা অনেক কষ্ট হতো। পোটেনশিয়াল ওটিট প্ল্যাটফর্ম আমাদের দেশে দেখিনি। আবার হইচই-এর কাছে সেল করাটাও যে সহজ ছিল তা-ও কিন্তু না। তাদের কনভেন্স করতে আমার মাসের পর মাস সময় লেগেছে। প্রত্যেকটি বিষয় ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয়েছে। তাদের আমার প্রতি বিশ্বাস তৈরি করতে হয়েছে।

রাইজিংবিডি: হইচই-এর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

শাওকী: হইচই থেকে লকডাউনের সময় যখন প্রথম ফোন করেন, তখন তারা কাস্টিংয়ের বিষয়ে কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন, তুমি আমাদেরকে প্রথম এপিসোডের চিত্রনাট্য দাও। এরপর তারা জানান, আমরা বুঝতে পেরেছি তুমি কোন ভাষায়, কীভাবে কথা বলতে চাচ্ছো। এখন আমাদের পুরো গল্পটা দাও। কিন্তু তখন আমার কাছে পুরো গল্পটা ছিল না। খেয়াল করে দেখবেন প্রথম এপিসোডে চরিত্রের সংখ্যা কম। এটার কারণ তখনো পুরো গল্প আমার কাছে নেই।

রাইজিংবিডি: তাহলে তো অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে?

শাওকী: হ্যাঁ, ভালো রকমের কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আর এটা সব প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রেই হওয়া উচিত। ‘তকদীর’-এ শুধু চঞ্চল চৌধুরীর মতো তারকা অভিনয় করেছেন বলে দর্শক পছন্দ করছে না। চঞ্চল চৌধুরী ‘তকদীর’-এ বোনাস। কিন্তু গল্পটা গুরুত্বপূর্ণ। গল্প সম্পন্ন হওয়ার পর হইচই থেকে বলা হয়, এবার কাস্টিংয়ের বিষয়ে কী ভাবছো? তার আগে একবারের জন্যও তারা বলেনি- এই তারকাকে কাস্ট করতে হবে। এতে মন্টু চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোহেল রানা মন্ডল। তিনি তো তারকা নয়। কিন্তু তাকে দর্শক গ্রহণ করেছেন। কারণ তার চরিত্র। এই চরিত্রে কোনো তারকাকে নিলে তাকে এভাবে হয়তো দর্শক গ্রহণ করতেন না।

রাইজিংবিডি: চঞ্চল চৌধুরীকে কাস্ট করলেন কেন?

শাওকী: এই কাজ করার আগে চঞ্চল ভাইয়ের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। চরিত্রটি খুবই জটিল। এই চরিত্রে মিশে যাওয়ার জন্য এবং চরিত্রের সঙ্গে দর্শকের অংশগ্রহণ করানোর জন্য একজন দক্ষ অভিনেতা দরকার ছিল। চরিত্রের বয়স ও চঞ্চল ভাইয়ের বয়স ও অভিনয় দক্ষতা মিলিয়ে মনে হয়েছে চঞ্চল ভাই কেন নয়?  

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়