ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দ্বিতীয় বিয়ে এবং সামাজিক মনস্তত্ত্ব

সাজিয়া সুলতানা পুতুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২২, ১৬ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৭:২৩, ১৬ এপ্রিল ২০২১
দ্বিতীয় বিয়ে এবং সামাজিক মনস্তত্ত্ব

সাজিয়া সুলতানা পুতুল

সন ২০২০। বীভৎস এক ছবি সারা বিশ্বের। মৃতের মিছিল বিশ্বজুড়ে। সবার মনে মহামারির আতঙ্ক, শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা। আমার মনে এরই সঙ্গে যুক্ত হলো ভয়াবহ আর এক অসুখ, ‘বিষাদ’। ব্যক্তিগত জীবনের টালমাটাল অবস্থার গভীর বিষাদ তখন তুঙ্গে। মাত্র এক বছরের মাথায় বিয়ে নামক গোলক ধাঁধার চক্কর থেকে বেরিয়ে আসার ধাক্কা সামলাতে আর সকলের কাছ থেকে সেই বিষাদকে আড়াল করতে প্রতিনিয়ত মিথ্যা হাসি হেসে যাবার অভিনয়।

দৃষ্টি এড়ায়নি কাছের মানুষজনের। সেই মিথ্যা হাসির অনুবাদটি যে নিঃসঙ্গতা, বুঝতে বাকি থাকেনি কিছু মানুষের। যে অল্প কয়জনের আমাকে পড়ার অনুমোদন আছে, পড়ে নিতে পেরেছে ঠিকঠাক। পাশে ছিল তারা। কিন্তু বাকিরা? ‘লোকে কী বলবে’ ব্যাধি কুঁকড়ে দিয়েছে আমাকে একটা বছর। কী করে প্রকাশ করি একক জীবনে ফিরে আসার উপাখ্যান? কী করে বলি এত সমারোহে করা বিয়েটা এত দ্রুত ভেঙে দিয়েছি ছন্দে ছন্দ মেলে নি বলে? লোকে তো বলবে, ‘ওই তো মিডিয়ার মেয়েদের কাছে বিয়েটা তো পুতুলখেলা। এরা ধরে আর ছাড়ে।’

আমি তো মেয়ে। প্রতিষ্ঠায় যোগ্যতায় যেখানেই থাকি না কেন, মেয়ে তো! লোকে তো গালমন্দটা আমাকেই দেবে। তা হলে উপায়? কুঁকড়ে যাব নিজের ভেতর? ‘সংসার কেমন চলছে’, ‘কবে যাবে স্বামীর কাছে’, ‘স্বামী দেশে আসছে না কেন’—এসব প্রশ্নের উত্তরে প্রতি মুহূর্তে মিথ্যা গল্প ফাঁদতে হবে? আমি তো সৎ স্বচ্ছভাবে জীবনযাপন করেছি। ব্যক্তিগত বা পেশাগত কোনো জীবনেই কোনো আড়াল রাখিনি কখনো। মাথা উঁচু করে মর্যাদার সাথে বেঁচেছি। তাহলে এবার নিজেকে নিয়ে প্রতিদিন মিথ্যা বলে যাব যে সব ঠিক চলছে?

যুদ্ধ চললো নিজের সাথে। তুমুল প্রবল যুদ্ধ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভর্ৎসনা করতে শুরু করলাম সত্য আড়াল করার অপরাধবোধে। একরাশ হতাশা ঘিরে ধরলো আমাকে। যতটা বিচ্ছেদের বিষাদ, ততটাই নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর গ্লানি। গানের ভেতর ডুব দেয়ার চেষ্টা করলাম। বেশ অনেকগুলো গান এলো। ততদিনে মেনেই নিয়েছি যে, লোকে কিছু বলার ভয়ে একটা মিথ্যা নিয়েই বাঁচতে হবে হয়তো। একটা বছর মনের সাথে যুদ্ধের পর অবশেষে মনে হলো, কোনো অপরাধ করিনি আমি। বরং জীবন আমাকে সাধুবাদ জানাবে সত্যিটা বলার জন্য, অভিবাদন জানাবে সত্যের সাথে থেকে জীবনকে যথাযথ সম্মান দেয়ার জন্য।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রায় এক বছর পর যখন সত্যটা সামনে অনলাম, জানালাম ভেঙে গেছে পুতুলবিয়ে, মুগ্ধ চোখে দেখলাম কিছু মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন আর ভালোবাসা। ঋণে আর কৃতজ্ঞতায় বিহ্বল হলাম। লোকে হয়তো কিছু বললো, অথবা বললো না। কিন্তু পাশে থাকা মানুষগুলোর শুভাশীষের কাছে তা নিতান্ত তুচ্ছ হয়ে গেল। সত্য বলার কী স্বস্তি সেইদিন থেকে বুঝেছি।

সন ২০২১। ওই যে বিষাদ সময়ে গানের ভেতর ডুবে থাকার চেষ্টা করেছিলাম, সেখানেই আমার সঙ্গীর সঙ্গে পুরোনো গান-বন্ধুত্বটা ঝালাই হওয়া। গানের দারুণ এক রসায়ন তৈরি হওয়া। এই রসায়নকে জীবনের রসায়নে রূপ দেয়ার ভাবনা বন্ধুর পরিবারের। ততদিনে আমার পূর্ববর্তী সম্পর্কের ক্ষত অনেকটাই প্রশমিত। কিন্তু আবারো সেই একই ভাবনা, ‘লোকে কী বলবে!’ বিচ্ছেদের এক বছরের মাথায় বিয়ের কথা জানলে কী প্রতিক্রিয়া হবে! লোকে হাসবে, আর বলবে, ‘একটা বছর যেতে না যেতে আবার?’

না, এবার আর কোনো আড়াল করিনি। কোনো মিথ্যার সাথে আপোস করিনি। জানিয়েছি সেই দিনই, যেদিন যুগল জীবনে প্রবেশ করেছি। কারণ আমার সেই বিষণ্ণ দিনগুলোতে সেই ‘লোকেদের’ আমি পাইনি। একেকটা নির্ঘুম রাতের শেষে আয়নায় তাকাতে যখন করুণা জাগতো নিজের প্রতি, তাদের আমি পাইনি। যখন গভীর রাতে খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশকে প্রশ্ন করেছি ‘কেন’, তাদের আমি পাইনি? যখন সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটার হাসি উবে গেছে বলে বাবাকে মুষড়ে যেতে দেখেছি, সেই লোকেদের আমি পাইনি। আমরা পাই না। তবু লোকের কথার ভয়ে আপোস করি, অথবা মিথ্যার সাথে সহবাস ঘটে প্রতিনিয়ত।

এবারো মানুষের অভিনন্দন আর শুভকামনায় প্লাবিত হলাম। আর মনে মনে ভাবলাম, দিনশেষে সত্যকেই ভালোবাসে মানুষ। লোকে হয়তো কিছু বলে, কিন্তু শুভকামনা আর শুভাশীষের তোড়ে সেসব কথাবার্তা ভাসতে ভাসতে নর্দমায় গিয়ে পড়ে। কিন্তু জীবন আর্শীবাদ দেয়। সত্যকে আলিঙ্গন করে জীবনকে নতুনভাবে ভালোবাসার জন্য সে সম্মানিতবোধ করে।

লেখক: সংগীতশিল্পী

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়