ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমাদের পাটকন্যা তাহমিনা

স্টার্লিং ডি মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ৯ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমাদের পাটকন্যা তাহমিনা

ছবি: তাহমিনা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত বাণী ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ স্বাধীনতার উনপঞ্চাশ বছর ধরে বাংলাদেশেও সভ্যতা বিনির্মাণে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা।

নারীরা আজ দেশ চালাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা হয়ে দেশকে বেকারত্বের হাত থেকে রক্ষা ও অন্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। আজ এমনই এক তরুণ নারী উদ্যোক্তার কথা বলব।

তিনি এই অল্প সময়ে উদ্যোক্তা জীবনে সুনাম করেছেন। ইতোমধ্যেই পাটকন্যা নামে অনেকের কাছেই পরিচিত তিনি। সেই সফল তরুণ নারী উদ্যোক্তা উম্মে তাহমিনা কবীর। কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানায় জন্ম তার। নিমক পুরুড়া গ্রামে চাচাতো ভাই-বোন মিলে ২১ জনের যৌথ পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। 

তাহমিনা পরিবারের ছোট হওয়ায় সবার আদর আর শিক্ষা পেয়ে বেড়ে উঠেন। তিনি মনে করেন, তার এই বড় পরিবারের সবার সহযোগিতায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছেন। তাদের কাছ থেকেই শেখা দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস আর মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠার মন্ত্র তাদের থেকেই পাওয়া।

তাহমিনা কবিরের বাবা ছিলেন একজন ভেটেরিনারি প্র্যাকটিশনার। গ্রাম্য সালিশের একজন সৎ বিচারক। কটিয়াদী উপজেলাসহ আশেপাশের উপজেলা পর্যন্ত তার সুনাম ও পরিচিতি ছিল। একজন আদর্শ নেতার ঘরে স্বপ্নবাজ তাহমিনা কবিরের জন্ম। তিনি বলেন, ‘জেনেটিক্যালি আমি আব্বার কাছ থেকে মানুষের জন্য কাজ করার সাহস আর শক্তি পেয়েছি।’

তিনি এসএসসি, এইচএসসি গচিহাটা পল্লী একাডেমি এবং গচিহাটা কলেজ পাস করেছেন। বর্তমানে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং এন্ট্রাপ্রেনারশিপ বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী তিনি।

একসময় অ্যাডভোকেট হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই এক স্যারের ডিমোটিভেশনের জন্য সেই ইচ্ছা বিলীন হয়ে যায়। তাহমিনা বলেন, ‘ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম মাথায় আসে আমাকে নিজে কিছু করতে হবে, আর যা অন্যদেরকেও পথ দেখাবে।’

যেই ভাবা সেই কাজ, প্রতিষ্ঠানের একটা সুন্দর নাম দিলেন। যার নাম -Dolly'S। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণন নিয়ে কাজ করছেন তিনি। তার উৎপাদিত পণ্যের মাঝে করপোরেট আইটেম, শপিং ব্যাগ, লোগো ডিজাইন, অফিস ডকুমেন্ট ফাইল, অর্নামেন্ট অন্যতম।

তিনি ২০১৭ সাল থেকে কাজ করছেন। প্রশ্ন করা হয়েছিল কোথাও থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কিনা শুরুর আগে? তিনি উত্তরে বলেন, ‘আমার শুরুর কথা বলতে গেলে বাংলাদেশ ইয়ুথ এন্টারপ্রাইজ অ্যাডভাইস অ্যান্ড হেল্পসেন্টারের (বি’ইয়া) নাম চলেই আসে। বি’ইয়া হলো একটি উদ্যোক্তা উন্নয়নের প্ল্যাটফর্ম। এর সাপোর্ট আর সহযোগিতা না পেলে চিত্রটা হয়তো অন্যরকম হয়ে যেত। শুরুতে একজন উদীয়মান তরুণের জন্য এমন সাপোর্ট তাকে কতটা বদলে দিতে পারে, আমি তার প্রমাণ।’

স্থায়ীভাবে এখনো কোনো কর্মচারী নেই। তবে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন বেশ কয়েক জন। এখনো কোনো অফিস নেননি তিনি। নিজ বাসাতেই একটা রুমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখেন নিশ্চয়ই একদিন বড় করে আউটলেট আর অফিস করবেন।

উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা ছোটবেলা থেকেই তার। কখনো চাকরি করবেন এটাই ভাবেননি। ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তার শুরু থেকে আলাদা কিছু করার চিন্তা ছিল। স্বাধীনভাবে নিজের পাশাপাশি অন্যদের জন্য কিছু করবেন এমন চিন্তা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা ছিল।

এই অবস্থানে এসে কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন আপনি? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ আমাদের সব ক্ষেত্রেই। আমি উদ্যোক্তা হতে চেয়েছি এটা বাস্তবায়ন করতে চ্যালেঞ্জ। একজন মেয়ে হয়ে কর্মী সামলাবো, মিটিং করবো, ক্লায়েন্ট ম্যানেজ করবো এগুলোও চ্যালেঞ্জিং। আমাদের সমাজ এখনো একটা মেয়ে বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করবে, এটা সোজা চোখে দেখতে নারাজ।’

‘আর ঢাকা শহরে, যেখানে ঘর থেকে বের হলে একজন মেয়ে সুস্থতা নিয়ে ঘরে ফিরে আসতে পারবে কিনা তা অনিশ্চিত। সেদিক থেকে আমার মতো নারী উদ্যোক্তা বা স্টুডেন্ট উদ্যোক্তাদের পুরো জার্নিটাই চ্যালেঞ্জিং। বিজনেস মিটিং, কাচামালের যোগার আর দৈনন্দিন কাজের সাথে নিজেকে নিরাপদ রাখাটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে পড়ে যায়। যা না হলে হয়তো আমাদের কাজের জায়গাগুলো আমাদের জন্য আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারতো’, বলেন তাহমিনা।

কি কি প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এসেছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পরিবারের প্রথম থেকে সাপোর্ট পেলেও পুরোপুরি আস্থা আনাটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন পর্যন্ত ফিনান্সিয়াল প্রতিবন্ধকতাটা সব চেয়ে বেশি। একজন মেয়ে হিসেবে মূলধন যোগার করাটাই কষ্টকর। মূলধনের স্বল্পতার কারণে ব্যবসার জন্য আলাদা অফিস সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা পারছি না। সেক্ষেত্রে একটা ছেলে হলে হয়তো এতটা কঠিন হতো না।’

আমাদের দেশে, যেখানে একটা ছেলেকে মায়ের গয়না বিক্রি করেও বিজনেসের মূলধন যোগার করতে দেওয়া হয়, সেখানে সাধারণভাবেও ফান্ডিং দিতে ভাবতে পারছে না অভিভাবকরা। একজন মেয়ে বলে সেই আস্থাটা কেউ করতে পারছেনা যোগ্যতা থাকার পরও। আমার ক্ষেত্রে বয়সটা অনেক সময় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কম বয়সী হওয়ায় মূল্যায়ন প্রথম দিকে কমই পেতে হয়েছে। নিজের মেধা আর সক্ষমতা দেখিয়েই জায়গা করে নিতে হয়েছে বেশির ভাগ সময়’, বলেন তিনি।

এখন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি কেমন আছেন? তাহমিনা বলেন, ‘পৃথিবী ভালো নেই। বর্তমানে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি একটা  অনিশ্চিত সময়ে আছে। একজন ছোট উদ্যোক্তা হিসেবে আমিও এর বাইরে নই। আপাতত সব বন্ধ করে রেখেছি। অনেক অর্ডার ক্যান্সেল হয়ে গেছে, ডেলিভারি আটকে আছে, প্রোডাকশন বন্ধ। এর আগের কথা যদি বলি, তিন বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছি গত বছরের শেষের দিক থেকেই বিজনেসের রেভিনিউ আসা শুরু করেছিল উল্লেখযোগ্যভাবে।’

‘সবকিছুর জন্য উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্সকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই মন থেকে। এটি দেশীয় পণ্যের একজন উদ্যোক্তার জন্য অত্যন্ত সহায়ক আর স্ট্রং প্ল্যাটফর্ম। আমার মতো দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করে এমন হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তারা এখানে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তুলছে। আর পড়াশোনা করছেন ব্যবসায়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে’, বলেন তিনি।

পাট ইন্ডাস্ট্রিতে যারা কাজ করেন প্রত্যেকের প্রায় একটা সমস্যায় পড়েন। পাটের ফেব্রিকসের অপ্রতুলতা। নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির উপর নির্ভর করতে হয় ফেব্রিকসের জন্য। তাহমিনা কবির পাটের ফেব্রিকস নিয়ে কাজ করতে চান। দেশ পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, কিন্তু সেদিক থেকে পাটের সেক্টরে আমাদের প্রয়োজনীয় কাচামালের সরবরাহ সমন্বয় করতে পারছি না উদ্যোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী।

তাহমিনা কবির স্বপ্ন দেখেন গ্রামে একটা পাটপণ্য উৎপাদনের কারখানা দেবেন, যেখানে কাজ করবে সব নারীরা। ডলিজের প্রত্যেক সেক্টরে নারীরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করবেন। ডলিজ হবে পাট পণ্যের সেরা ব্র্যান্ড, যেখানে পাটের জুতা থেকে শুরু করে পাটের তৈরি ঢেউটিনও থাকবে।

তাহমিনা কবির বলেন, ‘উদ্যোক্তা হওয়াটা এখন হালের ট্রেন্ড হয়ে গেলেও আমরা সবাই উদ্যোক্তা হতে চাইছি এটিই আশার বিষয়। চাকরির দিকে না দৌড়ে নিজের পরিচয় গড়ে তোলার ইচ্ছাটাই একদিন অনেক উপরে নিয়ে যাবে আমাদের। নতুনদের জন্য বলবো, সাহস নিয়ে শুরু করে দিন। এরপর লেগে থাকুন। সৎ থেকে নিজের পরিশ্রমে লেগে থাকুন। পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না।’

লেখক: তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ঢাকা/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়