ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

উদ্যোক্তাদের মূল্যায়ন মানে দেশের উন্নয়ন 

সানজানা হোসেন অন্তরা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০  
উদ্যোক্তাদের মূল্যায়ন মানে দেশের উন্নয়ন 

সানজানা হোসেন অন্তরা

উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার কমিয়ে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোক্তাদের সামাজিক স্বীকৃতির বিকল্প নেই। উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। একজন ব্যক্তি যখন নিজের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে কোনো চাকরি বা কারো অধীনস্থ না থেকে, নিজে থেকেই কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার চেষ্টা করেন বা পরিকল্পনা করেন, তখন তাকে উদ্যোক্তা বলে। 

ব্যবসায় উদ্যোক্তার উদ্যোগ যখন সফল বা স্বনির্ভর হয়, তখন তাকে বলে ব্যবসায়ী। বর্তমানে বাংলাদেশেও উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বেড়েই চলছে এবং এদের বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থী। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত অধিক জনসংখ্যার পাশাপাশি বেকারত্ব একটি প্রধান সমস্যা হয়ে রয়ে গিয়েছে। নতুন করে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার বৃদ্ধি একটা চিন্তার বিষয় হয়ে দেখা দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তাই বহু শিক্ষার্থী নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে এবং ‘চাকরি করবো’ এই কথার চেয়ে ‘চাকরি দেব’ এ কথায় বিশ্বাসী হয়ে উঠছে।

এত আশার আলো থাকার পরেও প্রতিবছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, এতে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার দিনকে দিন বাড়ছেই। ২০১৯ এ  ILO(আইএলও) থেকে প্রকাশিত এশিয়া প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড স্যোশাল আউটলুক -২০১৮’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের বেকারত্ব, তরুণদের কর্মসংস্থান, নিষ্ক্রিয় তরুণের হার ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং এই প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হারে ২য় সর্বোচ্চ বাংলাদেশ (১০.০৭) শতাংশ। 

এই প্রতিবেদনে আরও দেখানো হয়, বাংলাদেশে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন পর্যায়ে বেকারত্বের হার কত। সেখানে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর পার হয়নি এমন মানুষের বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম (১.০৮ শতাংশ), অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি (১০.০৭ শতাংশ) যা খুবই হতাশাজনক।

এত শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবল আগ্রহ থাকার পরও বাংলাদেশের এ অবস্থার পেছনে অন্যতম ও প্রধান কারণ হলো উদ্যোক্তাদের অবমূল্যায়ন। এদেশে উদ্যোক্তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। যখন কেউ আত্মসম্মানের সাথে নিজ উদ্যোগে কিছু করতে চায়, আশেপাশের মানুষ ভ্রু কুচকিয়ে এমনভাবে দেখে তাদের দিকে, তারা তাদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অনেকে আবার উদ্যোক্তাদের কাজকে কোনো পেশার অন্তর্ভুক্ত বলে মনেই করেন না। 

আমাদের পরিবার, সমাজ এখনো চিন্তা ভাবনায় অনেক পিছিয়ে, তারা শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা একমাত্র সরকারি চাকরিতেই খুঁজে পায়। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে চাকরির বাজার যেন এক সোনার হরিণ, সেখানে একটা মনমতো চাকরি প্রায় অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় নিজের ও দেশের উন্নতির কথা ভেবে কেউ যখন নিজে কিছু করতে চায়, তা আমাদের সমাজ সময় নষ্ট হিসবে বিবেচনা করেন। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিগুলো একজন উদ্যোক্তা হয়েই কাজ শুরু করে সফল ব্যবসায়ীতে রূপান্তর করেছে নিজের ভাগ্যকে।

উদ্যোক্তারা কাজ শুরু করে নিজের মেধা, শ্রম, ইচ্ছে দিয়ে, তাদের শুধু দরকার আপনজনদের থেকে, সমাজ থেকে কিছুটা উৎসাহ। কিন্তু আমাদের সমাজ এখনো উদ্যোক্তাদের কাজকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারেনি, উদ্যোক্তারা সঠিক মূল্যায়ন পায় না। অনেকে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পরেও শুধু প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকায় যথাযথ সম্মান থেকে বঞ্চিত হন।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে মজার ছলে বলেন, উদ্যোক্তাদের সামাজিক স্বীকৃতি না থাকায় বিয়েতে সমস্যা। সত্যি তাই, প্রত্যেক পেশায় সঠিক মূল্যায়ন ও সম্মান অতীব জরুরি, কিন্তু বাংলাদেশে উদ্যোক্তারা এখনো সেই মূল্যায়ন পায়নি।

বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য উদ্যোক্তাদের যথাযথ মূল্যায়ন অতীব জরুরি। দেশের অনেক শিক্ষিত তরুণ ফ্রিল্যান্সার বা উদ্যোক্তা হিসেবে ভালো আয় করেন, কিন্ত সামাজিক স্বীকৃতি নেই। সম্প্রতি ২৫ আগস্ট ২০২০, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তাদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি কীভাবে দেওয়া যায়, তা ভাবতে হবে।’

আমাদের বর্তমান সরকার উদ্যোক্তাদের নিয়ে ইতোমধ্যে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে, আশা করছি অতিদ্রুত বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যা উদ্যোক্তাদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে সাহায্য করবে। তবে সরকারের একার পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়, দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা এবং সেজন্য নিজেদের মনোভাব আগে পরিবর্তন করতে হবে। উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিয়ে তাদের পাশে থাকা, তাদের কাজকে যথাযথ মূল্যায়ন করা, তাদের পেশাকে সম্মান করা।

একজন উদ্যোক্তা যখন নিজের চেষ্টা, শ্রম, মেধা এবং অন্যদের অনুপ্রেরণায় নিজেকে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তখন সে নিজে আরও হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারবে। এরকম হাজার উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ যদি সফল হয়, তবে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার যেমন কমবে, ঠিক একইভাবে অনেক কর্মহীন মানুষ আত্মসম্মানের সাথে আত্মনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে পারবে। আমাদের দেশের নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে, তবুও তাদের মাঝেও বর্তমানে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবল আগ্রহ, অনেক গৃহিণীরাও নিজস্ব দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পথে পা বাড়িয়েছে, যা তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করছে, সমাজে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করছে।

অধিক জনসংখ্যার এই অভিশাপ থেকে দেশকে তখনই রক্ষা করা সম্ভব, যখন এই বিপুল জনসংখ্যার কাজের ব্যবস্থা করে, আত্মনির্ভরশীল করে জনসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব হবে। আর সে জন্য উদ্যোক্তাদের উদ্যোগকে সফল করে নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে, যেন তারা আরও উৎসাহের সাথে কাজ করে, প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নিজ উদ্যোগে এবং অন্যদেরও কর্মসংস্থানের সু্যোগ করে দিতে পারে। তবেই এদেশের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, তবেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাবি/মাহি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়