ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

‘তাঁতশিল্প প্রসারে ই-কমার্স ব্যাপক ভূমিকা রাখবে’

মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১০, ৯ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:২০, ৯ নভেম্বর ২০২০
‘তাঁতশিল্প প্রসারে ই-কমার্স ব্যাপক ভূমিকা রাখবে’

দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানুষের চাহিদা। আর চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের অনেক ঐতিহ্য। 

প্রাচীন লোকশিল্পের মধ্যে হাতে বুননের তাঁত, জামদানি, মসলিন কাপড় বা শাড়ির শহর ‘টাঙ্গাইলের পাথরাইল’। ঈদ বা স্বাভাবিক সময়ে বেচাকেনা ভালো হলেও বর্তমান বৈশ্বিক সংকট করোনায় ব্যবসার পরিস্থিতিতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন অনেক তাঁতি পরিবার ও পাইকারি বিক্রেতারা।

ঊনিশ শতকের শেষের দিক থেকে প্রায় ৬০ হাজার পরিবার নির্ভর করত হাতে বোনা তাঁতের টানার (কাঠের তৈরি যন্ত্র বিশেষ) উপর। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে বর্তমান হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম মেশিনের আবির্ভাবের পর থেকে কমে যায় হাতে বোনা তাঁত শিল্পের। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক পরিবার। কেউ তাঁতের সরঞ্জামাদি বিক্রি করে পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে আবার কেউবা জীবনের তাগিদে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা।

তাঁত কারিগর স্বপন পাল বলেন, ‘৩৫ বছর যাবত তাঁত ও কারখানার সঙ্গে জড়িত আছি। বাপ-দাদার আমলে হাতে বোনা কাপড়ের চাহিদা থাকলেও এখনকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। পণ্য অর্ডারের পরিমাণ কম থাকায় মজুরি কম। প্রতি পিস শাড়িতে ১৫০০ টাকা পাই। একটি ভালো নকশার শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে ৭ দিন। সেই হিসেবে মাসে ৭\৮ হাজার আয় করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে সংসার খরচ চালানো অনেক কষ্টের।’ 

‘মাঝে মাঝে কিছু ক্রেতা আসে, যারা নেটে (ইন্টারনেট) ব্যবসা করে, তাদের নকশা অনুযায়ী আমাদের শাড়ি তৈরি করে দিতে হয়। তবে এ ধরনের ক্রেতা বাড়লে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে তাঁত কারিগর। 

চিত্ত সরকার নামে আরেক তাঁত শ্রমিক ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, মেশিনে তৈরি তাঁতের শাড়িতে খরচ কম ও সুতার বুনন নিখুঁত হওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদা দিন দিন সেদিকেই বাড়ছে। অন্যদিকে হাতে তৈরি তাঁতের সুতি ও সিল্ক শাড়িতে পরিশ্রম, মজুরি, সুতার মূল্য বেশি থাকায় ক্রেতাদের চাহিদা কম। 

প্রতিদিন এমন কিছু ক্রেতা এসমস্ত প্রতিষ্ঠানে যান, যারা অনলাইনে ব্যবসা করেন, তারা মূলত নিজস্ব নকশায় হাতে বুননের তাঁতের শাড়ি চান। তবে, এদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। এধরনের ক্রেতা যদি বাড়ানো যায়, তাহলে কিছুটা হলেও তাঁতি ও দেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প রক্ষা পাবে বলে মনে করেন তাঁতি চিত্ত সরকার।

পাথরাইলের স্থানীয় ও আদি ব্যবসায়ী কালা চাঁদ বসাক বলেন, ‘আমার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে টাঙ্গাইল শাড়ি। আমার দাদা ও পরদাদা থেকে এই ব্যবসায় জড়িত আছি। পূর্বে হাতে বোনা টাঙ্গাইল শাড়ি ও খটখটির (কাঠের তাঁত যন্ত্র) ব্যবহার বেশি থাকলেও যুদ্ধের পর থেকে ধস নামে তাঁত কারখানা ও কারিগরদের জীবনে।’ 

‘সুতা, শ্রমিক মজুরি ও পরিশ্রমের মূল্যায়নের দিক বিবেচনা করলে আসল তাঁতের শাড়ির মূল্য যদি ২০০০ হয়, পাওয়ারলুম মেশিনে তৈরি একই তাঁতের শাড়ির দাম হয় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে। কম মূল্যের কারণে মেশিনে তৈরি কাপড়ের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি থাকায় বাধ্য হয়ে আমাদের আসল তাঁত বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের চাহিদা অনুযায়ী মজুরি দিতে না পারায় ছাটাই করতে হচ্ছে অনেক অভিজ্ঞ কর্মীদের’, বলেন তিনি।

পাইকারি শাড়ি বিক্রেতা চন্দন কুমার বসাক বলেন, ‘১৯৮৪ সাল থেকে টাঙ্গাইলের তাঁত বস্ত্র নিয়ে পৈত্রিক ব্যবসা করছি। আমার নিজের কারখানায় তাঁত ছিল ৩৫টি। শ্রমিকদের মেধা ও পরিশ্রম সঠিক মূলায়ন করতে না পারায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে কারখানা। বর্তমানে আমার ব্যবসা নির্ভর করছে মেশিনে উৎপন্ন তাঁতের শাড়ি দিয়ে। মূলত পণ্যের দাম বাড়ে মজুরির জন্য।’ 

‘সরকার যদি দেশ-দেশের বাইরে পণ্য পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা করতো ও তাঁতশিল্পে ভর্তুকি দিতো, তাহলে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষা করা সহজ হতো। বেঁচে যেত ৮ হাজারের মতো পরিবার’, বলেন তিনি। 

ই-কমার্সের ভূমিকা ও অনলাইনে বিক্রি করেন এমন ক্রেতার কথা জিজ্ঞেস করলে কারখানার তাঁতি ও মালিক পক্ষ উভয়েই বলে, এই শ্রেণির ক্রেতা আগে দেখা না গেলেও ইদানিং কিছু ক্রেতা আসেন, যারা নিজেদের করা ডিজাইন দেখিয়ে হাতে তৈরি টাঙ্গাইলের আসল তাঁতের শাড়ি ক্রয় করেন, তবে এরা সংখ্যায় কম। 

ভবিষ্যতে যদি এমন ক্রেতার পরিমাণ বাড়ানো যায়, তাহলে বিক্রির পরিমাণ বাড়বে। আবার অনলাইনের মাধ্যমে দেশ ও দেশের বাইরেও তাদের নিজের দেশের পণ্যকে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব বলে তারা মনে করেন। 

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি। 

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়