ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উই’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো নারীর স্বপ্ন: নিশা

মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ৭ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৯:০০, ৭ ডিসেম্বর ২০২০
উই’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো নারীর স্বপ্ন: নিশা

নাসিমা আক্তার নিশা, ফেসবুক গ্রুপ উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) এর স্বপ্নদ্রস্টা ও প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তিনি উই’র প্রেসিডেন্ট। এছাড়া ই-ক্যাবের (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে অনেক তরুণের স্বপ্ন তৈরি করেছেন তিনি, বানিয়েছেন উদ্যোক্তা।  রোববার (৬ ডিসেম্বর) ঢাকায় তার বাসায় উদ্যেক্তা, ই-কমার্সসহ নানা বিষয়ে কথা হয়। কথোপকথনে ছিলেন  রাইজিংবিডির উদ্যোক্তা পাতার সহ-সম্পাদক  মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া।  এ সময় উপস্থিত ছিলেন পত্রিকাটির উদ্যোক্তা ও ক্যাম্পাস পাতার সম্পাদক হাকিম মাহি।

রাইজিংবিডি: কেমন আছেন?

নাসিমা আক্তার নিশা: ভালো আছি।

রাইজিংবিডি: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।

নাসিমা আক্তার নিশা: আমার শৈশব কেটেছে আমার ভাই-বোনদের সঙ্গে। পৈতৃকসূত্রে বনানীতেই আমার জন্ম। আমার প্রতিটা ভাই-বোনের সঙ্গে আমাদের কাজিনদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের বাসায় অনেক কাজিনরাও থাকতো। কিন্তু আমার সমবয়সী কোনো কাজিন না থাকায় খুব একাকিত্ব বোধ করতাম। 

আমার আব্বার সঙ্গে আমার খুব ভালো সময় কেটেছে। মাঝেমধ্যেই অফিসে বা বাইরে যাওয়ার সময় আব্বা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আমার মামা ছিলেন আমাদের বাসার পাশেই। মামার সঙ্গেও আমার শৈশবের বেশ ভালো স্মৃতি মিশে আছে। সবার খুব আদরের মানুষ ছিলাম আমি। এভাবেই কেটেছে আমার ছোটবেলা।

রাইজিংবিডি: আপনার শিক্ষাজীবন নিয়ে যদি বলতেন।

নাসিমা আক্তার নিশা: আমার আব্বা আমাকে কখনোই বনানী এলাকার বাইরে যেতে দিতো না। আমি ছোটবেলায় খুব বেশি কথা বলতাম বলে বাবা বলতো, তোকে আমি ল-ইয়ার বানাবো। তখন থেকেই মাথায় নিয়েছিলাম আমাকে ল-ইয়ার হতে হবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

১৯৯৭ সালে আমি বনানী মডেল স্কুল থেকে এসএসসি পাস করি। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইসএসসি পাস করি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুটোতেই মানবিক বিভাগে ছিলাম। যেহেতু আমি ল-ইয়ার হবো আমাকে অন্যকিছু করার দরকার ছিল না। আমাকে স্কুলের শিক্ষকরা বলেছিলেন, ইংরেজিতে জোর দাও ও মানবিক বিভাগে পড়। ব্যবসা করব কখনো চিন্তাও করিনি। কিন্তু যখন ল’এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি,  তখন দেখলাম ১৯৯৯ সালে ল’ এর জন্য বনানীর আশেপাশে তেমন ভালো কলেজ নেই। সেটা করতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’তে অনার্স করতে হবে। আব্বা এতদূর যেতে দেবে না। 

আমার তৎকালীন বয়ফ্রেন্ড ফয়সাল শিকদার (বর্তমান স্বামী) সেও এতদূর যেতে না দেওয়ার পক্ষে ছিল। ঘরের পাশে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। আমি গ্র্যাজুয়েশনও করেছিলাম একটা কলেজ থেকে।

তারপর পড়াশোনা অবস্থায় আমার আব্বা অসুস্থ হয়ে যান। বাবার অসুস্থতার পর তার অফিসে জয়েন্ট করি। আব্বা মারা গেলেন। তখন ফুলটাইম আব্বার অফিসে সময় দিতে হতো। এমবিএটা করি ২০১০ সালের শেষের দিকে। আমার বাবা ও স্বামী দু’জনেরই ইচ্ছা ছিল আমি যাই করি না কেনো পিএইচডিটা যেন সম্পন্ন করি। সে জন্যই এমবিএতে ভর্তি হয়েছিলাম। এমবিএ করাকালীন ফুটফুটে ছেলে সন্তান আয়ানের মা হয়ে গেলাম। অনেক কষ্টে এমবিএ করলেও পিএইচডি পর্যন্ত যেতে পারিনি।

রাইজিংবিডি: উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স) ফোরামের শুরুটা কীভাবে ছিল?

নাসিমা আক্তার নিশা: কোনো কাজই সহজে শুরু করা যায় না। ইনফ্যাক্ট শুরু করার পরও অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে। অক্টোবর ২০২০-এ উই’র তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। এখনও আমরা অনেক সমস্যার মোকাবিলা করি, তবে আগের তুলনায় অনেক কম।

আইটি সেক্টর নিয়ে ‘রেভারি করপোরেশন’ নামে আমার নিজের একটা সফটওয়্যার কোম্পানি ছিল ও তা এখনও আছে।  আমি যখন বাবার ব্যবসা থেকে বের হয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করি, তখন কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হই। সেই বাঁধাগুলো উত্তরণের জন্যই নারীদের জন্য এমন প্ল্যাটফর্ম তৈরির চিন্তার উদ্ভাবন ঘটেছিল। যেখানে নারীরা বাঁধা ছাড়া কাজ করতে পারবে।  আসলে যেকোনো কাজেই বাঁধা থাকবে। কিন্তু যেই ধরনের বাঁধা তাদের পাওয়া উচিত না, সেটাও নারীরা পায়।

২০১৭ সালে উইকে নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল আমার। উই শুরুর পর অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমার ভেতরে যথেষ্ট ধৈর্য শক্তি ছিল। ধৈর্য ধরে টিকে ছিলাম বলে আজকে আমার উই এখানে আসতে পেরেছে।

রাইজিংবিডি: উই’র সদস্যসংখ্যা, বর্তমান অবস্থা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে যদি কিছু বলেন।

নাসিমা আক্তার নিশা: বর্তমানে উই’র সদস্য প্রায় ১১ লাখের মতো। উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে আমরা সবসময় লক্ষ রাখি। কারণ, আমি যখন আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে আসি, আমার পড়াশোনা কিন্তু আইটিতে ছিল না।  আমি ঠোকর খেয়ে খেয়ে বা সমস্যায় পড়ে পড়ে শিখেছি। তখন আমার মনে হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলো যদি আরও ভালোভাবে করতাম, তাহলে আজ ঠেকতে হতো না। কারণ, ৬ ক্রেডিটের আইটিতে তখন পাস করার জন্য পড়তাম।

আমার তখন মনে হয়েছে, উই থেকে উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আমরা করতেই পারি। যেটাতে উদ্যোক্তারা তাদের নিজেদের ব্যবসা নিয়ে স্কিল বৃদ্ধি করতে পারবে। কারণ, প্রত্যেকের ভেতরে দক্ষতা থাকে। উই’র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা তাদের জানার পরিমাণটাকে ভালোভাবে রিভাইজ করতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় উই থেকে আমরা অফলাইন-অনলাইনে ট্রেনিং ও ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করেছি। আইসিটি মিনিস্ট্রির সহায়তায় কোর্সেরা ও মাস্টারক্লাস নামে ইন্টারন্যাশনাল মানের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছি।

এছাড়াও গ্রুপের সদস্যদের শেখার আগ্রহ থেকে এখানে ফ্রিতে প্রশিক্ষণের সুযোগও রয়েছে। পাশাপাশি বেকিং, কুকিং, ফটোগ্রাফি ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়েও আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। ২০১৭ সাল থেকেই লক্ষ করলে দেখবেন, প্রতি মাসেই উই থেকে কোনো না কোনো ট্রেনিংয়ের আয়োজন ছিল। তাছাড়া উদ্যোক্তাদের জন্য নানা ধরনের সেমিনার বা মেলার আয়োজন করেছি।

রাইজিংবিডি: দ্রুততম সময়ের মধ্যে উই’র সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কী ছিল?

নাসিমা আক্তার নিশা: এটার মূল কারণ হিসেবে বলবো, মানুষের ভেতরে শিক্ষার একটা আগ্রহ ছিল। ছিল তাদের বাঁচার তাগিদ। করোনায় যখন অনেকের আয় বন্ধ হয়, তখন আমাদের গ্রুপে জয়েন করে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিছু একটা করতেই হবে। করোনায় যখন অনেকেই হতাশায় ছিল, তখন আমাদের উই গ্রুপও পুরোদমে সচল ছিল। কারণ, আমাদের এখানে হতাশাকে প্রশ্রয় দেওয়া হতো না। আমাদের গ্রুপ কখনোই থেমে ছিল না, সবসময় চলেছে। আমরা সর্বদা পজেটিভিটিকে স্বাগতম জানাতাম। এজন্য আমাদের গ্রুপও তড়িৎ গতিতে এগিয়েছে।

রাইজিংবিডি: উই নিয়ে সফল হতে কাদের ভূমিকা বেশি ছিল?

নাসিমা আক্তার নিশা: উইকে সফল করতে এখন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে আছেন উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যার। তিনি ই- ক্যাবের (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যেহেতু আমি ই-ক্যাবের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলাম, একটা অ্যাসোসিয়েশনে থেকে একটা সংগঠন করা খুব সহজ ছিল না। ওই সমেয়ে রাজিব আহমেদ স্যার প্রেসিডেন্ট থাকায় তিনিই আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। তখন আমার মনে হলো এবার আমি আমার স্বপ্নকে পূরণ করতে পারবো। রাজিব স্যার গত বছর থেকে উইতে উপদেষ্টা হিসেবে হন।

তারপরই ২০১৯ সালের নভেম্বরে আমার স্বামী পৃথিবী থেকে পরোলোক গমন করেন। আমি সবকিছু ছেড়েই দিয়েছিলাম। রাজিব স্যার সেই সময় হাল ধরে ছিলেন উই’র, আর সেই কারণেই পুনরায় ফিরে আসতে পেরেছি উইতে। শুধু উদ্যোক্তাদের সামনে নিয়ে আসার জন্য।

পাশাপাশি আমাদের সব উপদেষ্টার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সবারই সক্রিয় ভূমিকা ছিল উইকে সামনে নিয়ে আসার জন্য। আমাদের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও হাইটেক পার্কের এমডি হোসনে আরা বেগম যথেষ্ট সহায়তা করেছেন প্ল্যাটফর্মটিকে সামনে নিয়ে আসার জন্য।

রাইজিংবিডি: উইকে নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?

নাসিমা আক্তার নিশা: উই নিয়ে আমার পরিকল্পনা ছিল অনেক বড় ও সুদূর প্রসারী। যদি বলি, আমাদের উদ্যোক্তারা যথেষ্ট ভালো কাজ করেন ও তাদের পণ্যও বিশ্বমানের বলা চলে। এই পণ্যগুলোকে আমি দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিতে। আমরা বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের পণ্যগুলো পাঠাবো। যেখানে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ বাই উই’ এমন ট্যাগলাইন থাকবে।

রাইজিংবিডি: উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

নাসিমা আক্তার নিশা: তাদের জন্য খুব বেশি কিছু বলবো না, আপনারা অবশ্যই সৎ থাকবেন ও সৎভাবে নিজের উদ্যোগকে সামনে নিয়ে আসবেন। পাশাপাশি ধৈর্য ধরবেন। আমাদের ভেতরে ধৈর্যের অনেক অভাব। আজকে যদি আমাদের ব্যবসায় লোকসান হয়, কালকেই আমাদের উদ্যোগ বন্ধ করে দেই। এটা করা যাবে না। সততা ও ধৈর্যের মাধ্যমেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

রাইজিংবিডি: রাইজিংবিডির উদ্যোক্তা পাতার পাঠকদের জন্য যদি কিছু বলেন।

নাসিমা আক্তার নিশা: দেশের উদ্যোক্তাদের খবর প্রকাশ করার জন্য আমি রাইজিংবিডিকে সাধুবাদ জানাই। আমাদের গ্রুপে যেসব উদ্যোক্তা জয়েন্ট করেছেন, তাদের কিন্তু নিউজ লাগে। সামান্য নিউজের জন্য তারা অনেক মোটিভেটেড হয়। আর রাইজিংবিডি আমাদের পাশে থেকে সেই সহযোদ্ধার কাজটাই করছে। আপনারা দেশীয় পণ্যকে প্রমট করছেন, এটা আশার সংবাদ। 

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়